ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানিতে ভোট নিয়ে প্রার্থীদের অভিযোগের ফর্দ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী-সমর্থকরা ঢাকায় গণশুনানিতে তাদের ভোটের দিনের অভিজ্ঞতা আর অভিযোগের ফর্দ তুলে ধরেছেন সাত সদস্যের প্যানেলের সামনে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Feb 2019, 04:04 PM
Updated : 22 Feb 2019, 04:07 PM

সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তাদের কথা শোনেন প্যানেল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন।

প্যানেলের সদস্য ছিলেন- অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক বিচারক সা ক ম আনিসুর রহমান খান ও অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ।

শুনানি শেষে কামাল হোসেন বলেন, “এই নির্বাচনকে (একাদশ সংসদ)  নির্বাচন বলা যাবে না। এটা তো নির্বাচন ছিল না, তথাকথিত নির্বাচন। এটা আজকে এই শুনানিতে আমরা বুঝতে পেরেছি- এটা কোনো নির্বাচন হয়নি।

“৪২ জনের কথা শোনার পরে আমরা বলতে পারি- এটাকে নির্বাচন বলা যায় না, এটাকে বলা যেতে পারে সরকার একটা প্রহসন করেছে, দেশের নাগরিকদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, সংবিধান অমান্য করেছে, গণতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি অবমননা করেছে।”

মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পরে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এহেন অবস্থাকে ‘দুঃখজনক’ অভিহিত করে তিনি বলেন, “আমাদের দুঃখ লাগছে, যে দলের নামে এগুলো হচ্ছে সেই দলটা কিন্তু আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দল। আমরাও সেই দল করেছি, লাখো লাখো লোক জীবন দিয়েছে তার ডাকে সারা দিয়ে। লক্ষ লক্ষ শহীদের তালিকা আমরা পাব।

“সেই দলের নামে এগুলো হল, এগুলো কোনোভাবে আমরা মেনে নিতে পারছি না। অনেকেই বলে যে, আওয়ামী লীগের নামে যেটা করা হচ্ছে এটাকে আওয়ামী লীগ বলা চলে না। আমরাও সেটা মনে করি। আমরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করেছি, এই আওয়ামী লীগ না।”

গণশুনানিতে দর্শকসারিতে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা

সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে কামাল হোসেন বলেন, “এক ব্যক্তির শাসন যে আছে, এটাকে অস্বীকার করতে পারেন না। এটা তো একদলীয় শাসনও হয়, এক ব্যক্তির শাসন, যা ইচ্ছা তাই।”

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে গণফোরাম সভাপতি বলেন, “আজকে অনেকে এখানে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির কথাটি বলেছেন। এটা একটি ন্যায্য দাবি। আমরা অন্যান্য প্লাটফর্ম থেকে এই মুক্তি চেয়েছি। আজকে সবাই এখান থেকে জোরালোভাবে তার মুক্তি চেয়েছেন। আমি অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি করছি।”

গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, নিতাই রায় চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, মাহমুদুল হাসান, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নুল আবদিন ফারুক, আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জহিরউদ্দিন স্বপন, জেএসডির আ স ম আবদুর রব, তানিয়া রব, শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, হাবিবুর রহমান তালুকদার, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, রেজা কিবরিয়া, আবু সাইয়িদ, জগলুল হায়দার আফ্রিক, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, এস এ ম আকরাম, শহিদুল্লাহ কায়সার, জাহেদ-উর রহমান, গণস্বাস্থ্যের জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাদের কাউকে দেখা যায়নি অনুষ্ঠানে। এছাড়া ২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বক অলি আহমেদসহ শরিক নেতারাদের অধিকাংশই ছিলেন অনুপস্থিত।

যেসব অভিযোগ করলেন প্রার্থীরা

একাদশ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের প্রচারে ক্ষমতাসীনদের বাধা, ভোটের আগের রাতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ‘ব্যালটে বাক্স ভর্তি করা’, বিরোধীপক্ষের প্রার্থী ও এজেন্টদের ‘হুমকি’, কেন্দ্র থেকে ‘মারধর করে’ এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ আসে শুনানিতে।

টাঙ্গাইল-৮ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী শুনানিতে বলেন,  এবার বাংলাদেশে ভোট হয়েছে ৩০ ডিসেম্বরের আগের দিন।

যশোর-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী অনিন্দ ইসলাম অমিত বলেন, “অবিরতভাবে আমার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। প্রচারের মাইক ভেঙে ফেলা হয়েছে, প্রচারককে মারধর করা হয়েছে। আমার ওপর তিন দফা বোমা হামলা, গুলিবর্ষণ ও আমার গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। ভোটের দিনও আমার গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে, আমি আহত হয়েছিলাম। তারপরও মাঠ ছাড়িনি।

“২০ তারিখের পর ২৯ তারিখ পর্যন্ত আমার এলাকায় ১৩টি মামলায় নাম উল্লেখপূর্ব এক হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে, সহাস্রাধিক অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। আমার প্রধান নির্বাচনী এজেন্টকে আসামি করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৫ তারিখ পর আমার পাশে কার্য্ত কোনো নেতাকর্মী থাকতে পারেনি। এইরকম অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে আমি ভোটযুদ্ধে মাঠে ছিলাম।”

হবিগঞ্জ-১ আসনের রেজা কিবরিয়া বলেন, “আমার হবিগঞ্জ-বাহুবল নির্বাচনী এলাকায় ভোটের আগেই মিথ্যা মামলায়, গায়েবি মামলায়, বিস্ফোরক মামলায়, ৮ বছরের আগেকার মামলায় নেতাকর্মী-সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্বাচনের দেড় মাস আগের থেকে নেতাকর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারে না, হাওড়ে লুকিয়ে থেকেছেন। দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এক নেতাকে বাড়িতে পায়নি, তার ১৬ বছরের ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। বলেছে, ‘তোর বাপ আসলে তোকে ছাড়ব’। এরকম পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বর কোনো ভোট হয়নি, হয়েছে চুরি হয়েছে, হয়েছে ডাকাতি।”

গাজীপুর-৩ আসনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী অধ্যক্ষ ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, তার নির্বাচনী এলাকায় ১৬৯টা কেন্দ্রের মধ্যে একটি কেন্দ্রেও স্বচ্ছ ভোট হয়নি। তার নিজের নামে করা স্কুলের কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা রিটার্নিং অফিসার খুলে ফেলেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

শুনানির শুরুতে চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

লালমনিরহাট-৩ আসনের আসাদুল হাবিব দুলু দাবি করেন, ভাটের আগেরদিন রাতেই তার এলাকায় ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। যার ভিডিও তার মোবাইলে রয়েছে।

কুড়িগ্রাম-২ আসনের প্রার্থী আমসা আমিন তার বাড়িতে পুলিশি নজরদারির অভিযোগ করেন।

ঢাকা-৬ আসনে গণফোরামের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরী বলেন, এলাকার ৯৮টি ভোটকেন্দ্রের কোনোটিতেই এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

গণশুনানিতে প্রার্থীদের মধ্যে বিএনপির নিতাই রায় চৌধুরী, মিজানুর রহমান মিনু, জয়নুল আবদিন ফারুক, হাবিবুর রহমান হাবিব, মনিরুল হক চৌধুরী, ফজলুর রহমান, খায়রুল কবির খোকন, শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ডা. শাহাদাত হোসেন, শ্যামা ওবায়েদ, সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, জেএসডির সাইফুল ইসলাম, গণফোরামের মোস্তফা মহসিন মন্টু, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, নাগরিক ঐক্যের এসএম আকরাম, নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) আহসান হাবিব লিংকন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

এজেন্টদের মধ্যে ওয়ারি থানার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সোনিয়া আখতার ভোটের দিন সকালে পুলিশের সামনে তার ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা তুলে ধরেন।

লক্ষীপুর-৪ আসনের প্রার্থী আ স ম আবদুর রবের স্ত্রী তানিয়া রব, যিনি স্বামীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন বলেন, “আমরা যারা ভোট করেছি তাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ৩০ ডিসেম্বর নাগরিকরা ভোট দিতে পারেনি। তারা অপমানিত হয়েছেন।”

সিরাজগঞ্জে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া মেরি বেগম তার অবর্ণনীয় ঘটনা তুলে ধররার সময় মিলনায়তনের প্রার্থী-সমর্থকরা আবেগময় হয়ে পড়েন। মঞ্চে বসা কামাল হোসেনসহ অন্যদের এসময় অশ্রুসজল দেখা যায়।

মেরি বেগম বলেন, “আমার একটা কথা দেশবাসীর কাছে, চোখ হারিয়েছি, আমার দুঃখ নাই। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুঃখ, আমি ৩০ তারিখে ভোট দিতে পারি নাই। যখন শুনছি ২৯ তারিখে রাত ১২টায় ভোট শেষ হয়ে গেছে, সবচেয়ে বড় কষ্ট হয়েছে তখন আমার। আমি দাবি জানাতে চাই, আমি ভোট দিতে চাই, আমাকে ভোট দিতে দেন নইলে আমার দুই চোখ ফেরত দেন।”

শুনানি শুরুর আগে চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন এবং নিহতদের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়।