বিএনপির নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দুই নেতার

একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির পর কাউন্সিল ডেকে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব এসেছে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতার কাছ থেকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2019, 02:42 PM
Updated : 18 Jan 2019, 08:37 PM

জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার এক আলোচনা সভায় বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদের বক্তব্যে সরাসরি দল পুনর্গঠনের কথা আসে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে অল্প কিছু নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে এই আলোচনা সভায় সভাপতির আসনে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

প্রধান অতিথির বক্তব্যের খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “একটি কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। তুলনামূলকভাবে ত্যাগী, যারা পরীক্ষিত নেতা-কর্মী, তাদেরকে নেতৃত্বে আনতে হবে। আমরা যারা ব্যর্থ বলে পরিচিত হয়েছি, আমাদের পদ ছেড়ে দিতে হবে তরুণদের জন্য। তাহলেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে।”

দলের নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে কারাগারে যাওয়ার পর গভীর সঙ্কটে পড়া বিএনপি কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট গড়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন সুদিনে ফেরার আশায়।

কিন্তু গত ৩০ ডিসেম্বরের ভেটে মাত্র ছয়টি আসনে জয়ের দেখা পেয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। দলটির চার দশকের ইতিহাসে আর কখনও এত বাজে ফল হয়নি। অন্যদিকে রেকর্ড ভোটে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মত সরকার গঠন করেছে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ।   

বিএনপি ও তাদের জোট ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ এনে অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনর্নির্বাচন দাবি করলেও নির্বাচন কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে। 

খন্দকার মোশাররফ বলেন, “২০০৮ সালে এমনিভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজিত হয়েছিলাম। তার পরপর কিন্তু আমরা দলের কাউন্সিল করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম এবং সারা দেশে আমাদের নেতা-কর্মীরা সাহসের সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। সেটার প্রমাণ হল ৩০ তারিখে, সরকার ভোট করতে সাহস পেল না।”

এ অবস্থা থেকে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দল পুনর্গঠনের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন স্থায়ী কমিটির এই নেতা।

মোশাররফের আগে বক্তব্য দিতে এসে স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা মওদুদ আহমদ বলেন, “যারা এই দুঃসময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের সামনের দিকে এনে দল পুনর্গঠন করতে হবে। দরকার হলে আমরা যারা, আমাদের বয়স হয়ে গেছে, আমরা সরে যাব। তারপরেও এই দলটাকে তো রাখতে হবে।

“এর একমাত্র উপায় হল পুনর্গঠন করা। এই কাজ আমাদের কয়েক মাসের মধ্যেই করতে হবে। তাহলেই আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।”

বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। সেটি ছিল ষষ্ঠ কাউন্সিল। তাতে দলের চেয়ারপারসন পদে  খালেদা জিয়া এবং জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান পদে তার ছেলে তারেক রহমান পুনর্নির্বাচিত হন। দীরন্ঘদিনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলতে পুরোপুরি মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

গত প্রায় তিন যুগ বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে আসা খালেদা জিয়া গত দশ মাস ধরে কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন এক যুগ ধরে। তিন মামলায় সাজার রায় মাথায় নিয়ে তারেকের ফেরার কোনো আশা বিএনপিকর্মীরা দেখছেন না।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে স্থায়ী কমিটির নেতাদের নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই কার্যত দল চালিয়ে আসছেন।

আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে ফখরুল বলেন, “অন্ধকারের মধ্য থেকেই আলোতে উঠে আসতে হবে। যে কথা বিজ্ঞ আলোচকরা বলেছেন, এখন তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে, যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে। এই দেশটা আপনাদের, আপনাদেরকে সেটা রক্ষা করতে হবে।”

তরুণদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “ভোটের অধিকার আপনাদের, আপনাদের সেটা রক্ষা করতে হবে। ভবিষ্যত আপনারাই, আপনারাই দেশকে রক্ষা করবেন- জিয়াউর রহমান সেটাই আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন- সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, পরাজিত না হওয়া। পরাজিত বোধ করলেই পরাজিত।”

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘নৈতিক পরাজয়’ ঘটেছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, জনগণ থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই নির্বাচন একটা কাজ করেছে, আওয়ামী লীগকে চিরদিনের জন্য মানুষের মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।”

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, দলের যারা ‘পঙ্গু’ হয়ে গেছে, যারা কারাবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে ‘মায়েরা-বোনেরা’ নির্যাতিত হয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

“আমাদের নেত্রী, গণতন্ত্রের মাতা, যিনি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পতাকাকে তুলে নিয়ে আছেন, এখন পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে মানুষ যার নামে একত্রিত হয়, তাকে কারাগার থেকে বের করে আনতে হবে। সেজন্য আমাদেরকে এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমগ্র দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।”

জিয়াউর রহমানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার সকালে শেরেবাংলা নগরে তার কবরে শ্রদ্ধা জানাবেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। তবে তার আগের দিন এই আলোচনা সভায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনের অর্ধেক আসনই ছিল ফাঁকা। নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে হাতে গোণা কয়েকজনকেই শুধু অনুষ্ঠানে দেখা গেছে।

আলোচনা সভায় কম উপস্থিতির দিকে ইংগিত করে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ‍ওমর বলেন, “কিছুদিন আগে আমাদের একটা সেটব্যাক হয়ে গেছে। এতে হতাশার কিছু নেই। আবার আমরা অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াব।”

যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে এই বিএনপি নেতা বলেন, “আপনারা অনেকে জানেন, ব্রিটেনের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কথা। তার নেতৃত্বে রক্ষণশীল দলের বিজয়ের সময় লেবার পার্টি মাত্র ২৪টি আসন পেয়েছিল। সেটা আমাদের মত কারচুপির ভোটে নয়, সুষ্ঠু ভোটেই…

“সেই লেবার পার্টি থেমে থাকেনি। একদিন সেই লেবার পার্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাই হতাশার কিছু নেই। নেতা-কর্মীদের বলব, হতাশ হবেন না।”

নেতা-কর্মীদের ‘জিয়ার আদর্শে’ জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে শাহজাহান ওমর বলেন, “আমি একটু ভিন্ন ভাষায় বলতে চাই, কেউ মাইন্ড করবেন না। যারা বর্তমানে দলের নেতৃত্বে আছেন, তাদেরকে আরও অ্যাকটিভ হতে হবে। জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে আমাদের নেতৃত্বকে এগিয়ে যেতে হবে। এটা করতে না পারলে নেতৃত্বে থাকার প্রয়োজন নেই।”

এবারের নির্বাচনে মির্জা ফখরুল ও খন্দকার মোশাররফ দুটি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বগুড়ায় খালেদা জিয়ার এক আসনে ফখরুল জিততে পারলেও ঠাকুরগাঁওয়ে নিজের আসনে হেরে গেছেন। আর কুমিল্লার দুটি আসনেই খন্দকার মোশাররফের হার মান হয়েছে। 

আলোচনা সভায় মোশাররফ বলেন, “আজকে যারা বলেন যে বিএনপি পরাজিত হয়ে এসেছে, আমি পরাজিত হয়ে এসেছি বলে মানতে পারি না। আমরা মনে করি, জনগণের কাছে আমাদের বিজয় হয়েছে, নৈতিকভাবে বিএনপি ও ধানের শীষের বিজয় হয়েছে।”

দলের পুনর্গঠনের বিষয়ে মওদুদ আহমদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে মোশাররফ বলেন, “সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সাময়িক কিছু সমস্যা যদি হয়েও থাকে, কিংবা একটু হতভম্ব যদি হয়েও থাকি, এ সময়টা কাটিয়ে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াতে পারলেই জিয়ার আদর্শ সফল হবে, তার জন্মবার্ষিকী সফল হবে।”

গত নির্বাচনের পরিস্থিতি তুলে ধরে নোয়াখালী-৫ আসনের পরাজিত প্রার্থী মওদুদ আহমদ বলেন, “আগের দিন ৪০ শতাংশ ভোট ভরে দিতে হবে- এটা ছিলো নির্দেশ। সেজন্য আমাদের সেই আশা, সেই প্রত্যাশা সম্পূর্ণভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

“নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত মামলা দিয়েছে। মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের সবাইকে এলাকা ছাড়া করেছে। কাকে নিয়ে নির্বাচন করব? কর্মী ছাড়া নির্বাচন হয়? যুব দল-ছাত্র দল ছাড়া নির্বাচন সম্ভব?”

সরকার তাদের পুরনো ‘নীল নকশার’ ওপর নির্ভর করে নির্বাচন করেছে মন্তব্য করে মওদুদ বলেন, “এটাকে নির্বাচন বলা চলে না। এটা কখনোই আমাদের সংবিধানসম্মত নির্বাচন হয় নাই। … আপনি যদি নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়েন, ওয়াশিংটন পোস্ট পড়েন, গার্ডিয়ান পত্রিকা পড়েন, লন্ডনের অবজারভার পড়েন, সারা দুনিয়াতে কেউ বিশ্বাস করে না যে এটা একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই প্রবীণ সদস্য বলেন, “আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। আমার কাছে মনে হয় আমাদের এখন দুই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে পুনর্বাসন। সারাদেশে আমাদের হাজারো নেতা-কর্মী ও তাদের পরিবার গত দেড় মাস প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন করতে হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের পুনর্বাসন ও দল পুনর্গঠন করা গেলে বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে বলে আশা প্রকাশ করেন মওদুদ।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদের পরিচালনায় এ আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, আবদুল মান্নান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান বক্তব্য দেন।

দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিলকিস জাহান শিরিনসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।