বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বৃহস্পতিবার এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের জন্য ‘মনোনয়ন বাণিজ্যসহ’ নানা কারণ বলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
আন্দোলন করে যারা ব্যর্থ হয় তারা নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “২০০৮ এর নির্বাচনে জনগণ আমাদের ম্যান্ডেট দিয়েছিল। ব্যাপক হারে ভোট পড়ে। আপনারা যদি ২০১৮ এর নির্বাচন আর ২০০৮ এর নির্বাচন তুলনা করেন, ২০০৮ এ কিন্তু ভোট পড়েছিল আরো অনেক বেশি। প্রায় ৮৬ ভাগ ভোট পড়েছিল। কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রায় ৯০ ভাগের উপরে ভোট পড়েছিল।”
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসনে জয়ী হয়, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য জোট শরিকসহ তাদের আসন দাঁড়ায় ২৬২টি। ওই নির্বাচনে মোট ভোটারের ৮৭ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে, ৭৪টি আসনে ৯০ শতাংশের উপরে ভোট পড়ে।
এরপর ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট হয়নি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন একক প্রার্থীরা। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৫৭ আসনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, জোটসঙ্গীদের নিয়ে তাদের আসন সংখ্যা ২৮৮টি।
সমালোচকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “অনেকেই লিখছে, অনেকেই অনেক কথা বলছে। কিন্তু তারা যদি এই তুলনাটা দেখেন, তাহলে দেখবেন যে ২০০৮ এর নির্বাচনে ভোট পড়েছিল অনেক বেশি। এবং জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। নৌকা মার্কায় ভোট পেয়ে আমরা দেশ সেবার কাজে নিয়োজিত হই।”
২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে জয়ের পর টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনকারী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির এই অবস্থার জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাদের আন্দোলনে সম্পদ ও প্রাণহানির কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “এভাবে তাদের সকল আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আর আন্দোলন যাদের ব্যর্থ হয়, নির্বাচনে তারা কখনো জয়ী হতে পারে না, এটা বাস্তবতা। আর সেটার প্রমাণ দিয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচন।
“এই আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা, এটা কখনো মানুষ মেনে নিতে পারে না। তখন জনগণই তাদের প্রতিরোধ করেছিল। যার ফলে তাদের আন্দোলন, ধর্মঘট যা আজ পর্যন্ত কিন্তু প্রত্যাহার করা হয়নি। সেটা অব্যাহত আছেই। কিন্তু জনগণ সেটাকে আর ধর্তব্যেই নেয়নি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “এ নির্বাচনে বিএনপির ব্যর্থতার কারণটা কী? সেটা আমি বলব, বিএনপিরই ভেবে দেখতে হবে। তারা যে অপকর্মগুলো করেছে। তারা যে অগ্নিসন্ত্রাস করে প্রায় ৩৯০০ গাড়ি, বাস, সিএনজি পুড়িয়েছিল। ৩৫০০ এর উপরে মানুষকে তারা পুড়িয়েছে, প্রায় ৫০০-এর কাছাকাছি মানুষ আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছে।
“তাদের এই অপকর্ম…তারা কীভাবে আশা করতে পারে যে, জনগণ তাদের ভোট দেবে? এমন কোনো অপকর্ম নাই তারা না করেছে।”
বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ‘মনোনয়ন বাণিজ্যের’ অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “তারা প্রার্থী নির্বাচন কীভাবে করেছে? রীতিমতো মনোনয়ন বাণিজ্য। একেকটা সিটে তিনজন-চারজন-পাঁচজন করে মনোনয়ন। যে যত বেশি টাকা দিচ্ছে সে প্রতীক পাবে। মনোনয়ন তারা অকশনে দিয়েছিল।”
সিলেটে ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ধামরাইয়ে জিয়াউর রহমান, নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকার ও চট্টগ্রামে মোর্শেদ খানের বিএনপির চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকা থেকে বাদ পড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যখন সিট অকশনে দেওয়া হয় তখন তারা নির্বাচনে জেতে কীভাবে?
লন্ডনে বসবাসরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিদেশে বসে মনোনয়ন বাণিজ্য করে প্রবাসীদের সঙ্গেও করা হয়েছে। যারা নমিনেশন নিয়ে এ ধরনের ট্রেড করেছে বা অকশনে দিয়েছে তারা কী করে আশা করে তারা জয়ী হবে?”
যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে জোটসঙ্গী করাও তাদের ভরাডুবির আরেকটি কারণ বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “তারা নমিনেশন দিল কাকে? যেখানে উচ্চ আদালত থেকে একটি দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী। সেই জামায়াতে ইসলামীর ২৫ জনই নমিনেশন পেয়েছে।
“বাংলাদেশের জনগণ এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। তারা যুদ্ধাপরাধীদের কখনো ভোট দেবে না, দিতে চায়ও না, তারা দেয়নি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “এইভাবে যাদের কোনো রাজনীতিই নেই। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মানি লন্ডারিং, এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করা, অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করা; এটা যাদের নীতি তারা জেতার আশা কীভাবে করে? বাংলাদেশের মানুষ কখনো তা মেনে নেয়নি, মেনে নেবে না, নিতে পারে না।”
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেশে ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারি ও গ্রেনেড হামলার’ মতো ঘটনা ঘটে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তাদের ওই দুঃশাসনের পরে আসে ইমার্জেন্সি। ইমার্জেন্সি এসে মানুষের ওপর আরো অত্যাচার।”
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৮- এই ২৮টা বছর মানুষের ‘খুব ভোগান্তি’ হয়েছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “অনেক কষ্ট এদেশের মানুষ পেয়েছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আমরা জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করি। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন আমাদের মূল লক্ষ্য। মানুষের জীবনে শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মাত্র ১০ বছরের মধ্যে যদি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে পারি তাহলে অতীতে যারা ২৮ বছর ক্ষমতায় ছিল তারা কেন পারে নাই? এটা হচ্ছে সব থেকে বড় প্রশ্ন।
“তার কারণ একটাই, তারা (বাংলাদেশের) স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেনি। আর যে কারণে ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে তারা হত্যা করে এই বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অর্জন তারা মুছে ফেলতে চেয়েছিল।
“তাদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ এগোতে পারেনি।”
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের জন্য ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “সেই সাথে সাথে আমাদের সকল শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের মানুষ-আমাদের সশস্ত্র বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী পেশাজীবী মহল অর্থাৎ আমাদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের পেশাজীবী প্রত্যেকটি মানুষ ব্যাপকভাবে আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে, ভোট দিয়েছে। যার ফলে আমরা বিপুল ভোটে আবারো নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছি।”
সাধারণ মানুষ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, উন্নয়ন চায়, নিজের জীবনের উন্নতি চায় এবং সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে তারা নৌকায় ভোট দিয়ে মানুষের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রত্যয় ঘোষণা করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন মানুষের জন্য যে আত্মত্যাগ করে গেছেন সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। সেটা অনুসরণ করে আমাদের পথ চলতে হবে। দেশের মানুষ যদি ভালো থাকে দেশের মানুষ যদি সুখী সুন্দর জীবন পায় তার চেয়ে বড় স্বার্থকতা একজন রাজনীতিবিদের জীবনে হতে পারে না।”
যুদ্ধাপরাধী, খুনি, সন্ত্রাসী, অগ্নিসন্ত্রাসীরা যেন আর কখনো ফিরে আসতে না পারে সে বিষয়ে দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, জাতির পিতা যেমন বলে গেছেন কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না ঠিক সেভাবেই কেউ দাবায় রাখতে পারে নাই, ভবিষ্যতেও পারবে না। জাতির পিতার প্রতি এটাই আমাদের ওয়াদা।”
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব।
দিবসটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই নানা কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠন।