তার এক চাচাত ভাই বলেছেন, মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন নিজের জন্য তিনি কী করছেন? বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরই তার ঘর এবং প্রতিটি মানুষই তার স্বজন বলে জবাব পেয়েছিলেন তিনি।
সৈয়দ আশরাফের পৈত্রিক বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বীর দামপাড়া গ্রামে। কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও জয়ী হন আশরাফ, যদিও নির্বাচনী প্রচারের কোনো সময়ও এলাকায় যাওয়া হয়নি তার।
৬৭ বছর বয়সী সৈয়দ আশরাফ ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কয়েক মাস ধরে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার সেখানেই মৃত্যু হয় তার।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী আশরাফের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই রাতেই কিশোরগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে আসে। দলীয় নেতাকর্মীসহ অনেকেই রাতে ভিড় করেন জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে।
শুক্রবার তার বাড়িতে গিয়ে স্বজন ও বন্ধুদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সবাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সৎ, পরোপকারী, নির্লোভ ও নিরহংকারী মানুষ হিসাবে বর্ণনা করেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে ছিল বয়সে আমার থেকে সাত দিনের ছোট। ছুটি-ছাটায় সে যখনই বাড়িতে আসত, আমরা একসাথে খেলাধুলা করতাম, ঘুরে বেড়াতাম, গল্প গুজব করতাম। আমার সাথে সে মনের সব কথা বলত। মন্ত্রী হওয়ার পরও এই বন্ধুত্বে ছেঁদ পড়েনি। সব সময়ই আমার খবর রাখত এবং যে কোনো প্রয়োজনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিত।
“আশরাফ সব সময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে থেকে সততার কথা বলত। সে যে কি পরিমাণ সৎ ও স্বচ্ছ মানুষ ছিল তা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ভালো বলতে পারবেন।”
গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতি সৈয়দ আশরাফের সহৃদয়তার কথা তুলে ধরে তার চাচাত ভাই সৈয়দ আল বোরহান বলেন, “সে এতই অমায়িক ছিল যে, বাড়িতে এলে আমাদেরকে সুযোগ না দিয়ে নিজেই প্রথম আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের কুশল জিজ্ঞেস করত। সে সব সময়ই আমাদের খোঁজ-খবর রাখত ও প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত।”
তার আরেক চাচাত ভাই সৈয়দ আব্দুল্লাহ হাসান হারুন বলেন, “সে ছিল অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ মানুষ। তার এতটাই দেশপ্রেম ছিল যে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হওয়ার পর একবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তো রাত-দিন দেশের জন্য কাজ করছ, কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্য কী করেছ?
“সে উত্তর দেয় এই বলে, গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরই আমার ঘর, প্রতিটি মানুষই আমার স্বজন। কেউ আমার আলাদা নয়।”
প্রতিবেশী মো. বাছির মিয়া বলেন, “সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে কোনো কাজের জন্য গেলে তিনি কখনও ফিরিয়ে দেননি।”
বীর দামপাড়া গ্রামে সৈয়দ আশরাফদের বাড়ি দেখাশুনা করেন খোরশেদা খাতুন।
“আমার নিজস্ব বাড়ি নির্মাণের জন্য তার মা আমাকে এই বাড়ির পাশেই ১৫ শতাংশ জায়গা দিয়ে গেছেন। ’৭৫ সালের দুঃখজনক ঘটনার পর দীর্ঘ ১৭ বছর সৈয়দ আশরাফ এই বাড়িতে আসেননি। তিনি যখনই আসতেন আমার কুশলাদি জেনে নিতেন ও সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।”
মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হয়।
এরপর বিরূপ পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যে চলে যান সৈয়দ আশরাফ। দীর্ঘ দিন পর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। আওয়ামী লীগের ওই সরকারে বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সালের কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন সৈয়দ আশরাফ।
২০০৯ সাল থেকে নানা ঘটনা এবং ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনের মধ্যে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার পাশাপাশি আশরাফের ভূমিকার কথা গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করেন দলটির কর্মীরা।
তার সততা, সহৃদয়তা ও গণতান্ত্রিক মানসিকতার প্রশংসা করেছেন প্রতিপক্ষ দল বিএনপির নেতারাও।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেছেন, সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে জাতি একজন ‘সত্যিকারের গণতন্ত্রীকে’ হারালো। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শূন্যতা তৈরি হল, তা সহজে পূরণ হবার নয়।
সৈয়দ আশরাফ এলাকায় কখনও কোনো অসৎ ও দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেননি বলে জানান তার এলাকার যশোদল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল হক বাবুল ও সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার রায়।
“সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন সৎ ও নির্মোহ রাজনীতিক,” বলেন শফিকুল।