গতিহারা জাতীয় পার্টি যাবে কোন পথে?

পাঁচ বছর ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ তকমা নিয়ে থাকার পর একাদশ সংসদের যাত্রা শুরুর আগে আবার সেই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টি।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2019, 07:23 PM
Updated : 2 Jan 2019, 07:33 PM

এইচ এম এরশাদের দলটি কি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাতেই থাকবে, না কি সরকারে যোগ দেবে, তার মীমাংসায় এখনও পৌঁছতে পারেননি দলের নেতারা।

গত পাঁচ বছর নিজেদের অবস্থান যে স্পষ্ট করতে পারেননি, তার স্বীকারোক্তি জাতীয় পার্টির শীর্ষনেতাদের মুখ থেকেও এসেছে নানা সময়ে।

এবার ভোটের পর বুধবার সকালে যখন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করছিলেন, তখন ভবনের নিচে নেতা-কর্মীরা স্লোগান দিচ্ছিল ‘মন্ত্রিত্ব নয়, বিরোধী দল’।

এই পরিস্থিতিতে বৈঠকে দলের গতিপথ ঠিক করতে না পেরে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন,  “সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা বুঝে আমরা ব্যবস্থা নেব।”

বনানীতে দলের কার্যালয়ের এই বৈঠকে ছিলেন না জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ; ছিলেন না জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও।

এরশাদের অনুপস্থিতির কারণ অসুস্থতা বলে জানালেও রওশনের অনুপস্থিতি নিয়ে নীরব ছিলেন জি এম কাদের। 

বুধবারের সভার পর জি এম কাদের ও মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ

২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গড়ে ভোটে অংশ নিলেও ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলে বদলে যায় সমীকারণ। আগের মতো সরকারে যোগ দিলেও সংসদে বিরোধী দলের আসন নেয় তারা।

সরকারে যোগ দিয়ে সংসদে কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে তাদের ভূমিকার পালন নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় সব সিদ্ধান্তেই ‘হ্যাঁ’ বলে আসা এই দলের নেতাদের কেউ আবার বলেছেন, সরকারের নানা ভুলের সমালোচনাও তারা সংসদে করেছিলেন।

গত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রশংসা পেলেও বিরোধী দল হিসেবে তাদের নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। বিএনপি নেতারা তাদের কটাক্ষ করে বলে আসছিল ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’।

২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ - টিআইবি'র এক গবেষণায় বলেছে, বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদে ‘অকার্যকর’ ভূমিকা রেখেছে।

বিরোধীদল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে যখন চারপাশে নানা প্রশ্ন উঠেছিল, তখন জাতীয় সংসদেই একদিন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, “আমরা বিরোধী দল হতে পারি নাই। এভাবে বিরোধী দল হওয়া যায়?”

“সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে লজ্জা লাগে। আমরা সরকারি, না বিরোধী দল?  বিদেশে গেলে বলতে পারি না আমরা কী?”

এবার নির্বাচনের আগে প্রচারণায় দলের চেয়ারম্যান এরশাদ বলেছিলেন,  “এবার আর গৃহপালিত বিরোধী দল হয়ে নয়, আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই।” 

রওশন এরশাদ রয়েছেন দলীয় কার্যক্রমে অনুপস্থিত

কিন্তু নির্বাচনের পর যে আসনের হিসাব দাঁড়িয়েছে, তাতে বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধী মহাজোটে থাকলেও জাতীয় পার্টির সামনে সেই সুযোগ রয়েছে।

নির্বাচনের পর গত মঙ্গলবার দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় এসে জাতীয় পার্টির নেতারা দলকে সংসদে ‘কার্যকর বিরোধী দলের’ ভূমিকায় দেখতে চাওয়ার কথা বলেছিলেন। বুধবার যখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা সভা করছিলেন, তখনও নেতা-কর্মীদের মুখে ছিল একই স্লোগান।

দলের যুগ্ম মহাসচিব জহিরুল আলম রুবেল, গোলাম মো. রাজু বলেন, মহাজোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জাতীয় পার্টির কোনো লাভ হয়নি।

দলের এই দুই নেতাই মনে করেন, জাতীয় পার্টি দশম জাতীয় সংসদের মতো এবারও আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে তাতে দল পড়তে পারে ‘ইমেজ সঙ্কটে’।

দলের ভাইস চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন আহমেদ বাবুল, রওশন আরা মান্নানরাও দলের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলছিলেন, আওয়ামী লীগের মুখাপেক্ষী হয়ে ‘দল তো টিকতে পারে না’।

এর মধ্যে বৈঠকেও শীর্ষনেতারা দলের রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি।

কো চেয়ারম্যান জি এম  কাদের বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনে নতুন এমপিদের শপথ অনুষ্ঠানের পর জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক হবে। সেখানেই জাপার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।

অসুস্থতা নিয়ে বাসায় থাকা ৮৮ বছর বয়সী এরশাদ ওই সভায় থাকবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। রওশন থাকবেন কি না, সেই নিশ্চয়তাও মেলেনি।

জমছে অভিযোগের পাহাড়

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের চেয়ে খারাপ ফলের পর অনিয়ম, নির্বাচনের আগে মনোনয়ন বাণিজ্য, জ্যেষ্ঠ নেতাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা- নানা অভিযোগ নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা।

হুট করে কারও কারও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বনে যাওয়া নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

মধ্যম সারির নেতারা বলছেন, দলটির সঙ্কটে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের তারা কাছে পান না। নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া তো দূরের কথা,  দলের বনানী ও কাকরাইলের কার্যালয়েও তারা যান না।

দলটির যুগ্ম মহাসচিব জহিরুল আলম রুবেল বলেন, “আমাদের অনেক নেতাই মনে করেন, একবার সংসদ সদস্য হয়ে গেলাম তো সারা জীবনে আর নামব না।  প্রেসিডিয়াম মেম্বারদের তো সুখে দুঃখে কর্মীদের পাশে থাকার কথা। যে কোনো পরিস্থিতি ট্যাকল দেওয়ার কথা। অথচ তারাই পার্টি অফিসে আসেন না। “

জাতীয় যুব সংহতির সভাপতি আলমগীর শিকদার লোটনের অভিযোগ,  “যারা পাজেরো জিপ নিয়ে আসছে, তারাই প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দলে এমনও অনেক সংসদ সদস্য আছেন, যাদের ব্যক্তিগত সহকারীরা পার্টি অফিস কোথায় সেটা জানেন না। যারা মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হচ্ছেন, তারা পার্টি অফিসে আসছেন না।”

সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও দলটির ভাইস চেয়ারম্যান রওশন আরা মান্নান বলেন, “পার্টি অফিসে না আসলে বলা হয়, কেন আসেননি? এলে বলা হয়, কেন এসেছেন? কোনো অনুষ্ঠান হলে আমাকে জানানো হয় না । নিজে থেকে খোঁজ নিয়ে আসি।  ইমেজের ক্ষতি হয়, তবুও তো দলটা ছেড়ে দিতে পারি না।”

সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর এইচ এম এরশাদ

গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সামরিক শাসক এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠনের পর এক হাতেই দলটি চালাচ্ছেন। তার সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু হতে দেখা যায়নি দলটিতে। এরশাদ নিজেও বলেন, সব সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন।

দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মাসুদা রশীদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান রওশন আরা মান্নানের অভিযোগ, দলের কমিটি গঠনের সময় ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয় না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে দলটির নতুন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলছেন, সব বিষয়ে এবার তিনি ‘কঠোর’ হবেন।

নির্বাচনের আগে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে ৮৮ বছর বয়সী অসুস্থ এরশাদ মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেন এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে রাঙ্গাঁকে সেই দায়িত্ব দেন। পরে আবার দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হাওলাদারকে।

ঋণখেলাপি হাওলাদার নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার হতাশায় আর দলীয় কার্যালয়মুখী হননি। শুধু দলের ইশতেহার ঘোষণা করে যান। এই অবস্থায় ভোটের আগে পুরোপুরি অগোছালো ছিল জাতীয় পার্টি।

আলমগীর শিকদার লোটন বলেন, “সাবেক মহাসচিবের মতো আমরা তো আর বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করতে পারি না।”

জাতীয় পার্টি নেতাদের বিভিন্ন সময় একে অন্যকে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির ‘লোক’ বলে অভিহিত করতে দেখা গেছে।  

রাঙ্গাঁ বলেন, “আমরা নির্বাচনী প্রচারণা সঠিকভাবে করতে পারি নাই। রংপুর-১ আসনে আমার নিজের, রংপুর-৩ আসনে নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। আমি ঢাকায় থাকতে পারিনি। আমাদের নির্বাচনী প্রচারণায় গলদ রয়ে গিয়েছিল।”

ভোটের তফসিলের আগে জামালপুরে জনসভায় গিয়েছিলেন এইচ এম এরশাদ

মহাসচিব নির্বাচন নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের কথা উঠে আসে লোটনের কথায়।

তিনি বলেন, “অতীতে যারা বিভিন্ন সময়ে দল থেকে বেরিয়ে গেছে, যাদের বহিষ্কৃত করা হয়েছে, তাদেরই আবার মহাসচিব করা হয়েছে। “

জাতীয় পার্টির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এরশাদের ইচ্ছায় দলের মহাসচিব বদলেছে যখন-তখন।

নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টিতে যুক্ত হওয়া পরিবহন মালিক নেতা রাঙ্গাঁকেও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চারবার দল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। সেকথা নিজ মুখেই স্বীকার করেন রাঙ্গাঁ।

তবে এরশাদকে ‘রাজনৈতিক পিতা’ অভিহিত করে তিনি বলেন, “আমাদের দলের চেয়ারম্যানের কোনো ভুল নেই। যদি তার কোনো কিছু ভুল মনে হয়, তবে তার পায়ে হাত দিয়ে সেটা বললেই হয়।”

রাঙ্গাঁ সেই সঙ্গে বলেন, “নিবেদিত কর্মীদের হুট করে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। এটা বন্ধ করা উচিৎ।”

“আঁতেলদের হাত থেকে আমাদের দলটিকে রক্ষা করতে হবে,” বলেন তিনি।