প্রতিবার নির্বাচনের আগে অস্থিরতা দেখা যায় জাতীয় পার্টিতে, যা দলটিকে পিছু টানছে বলে মনে করছেন এবার নির্বাচনের আগে মহাসচিবের দায়িত্ব নেওয়া রাঙ্গাঁ।
তিনি এইচ এম এরশাদের এই দলকে ‘আঁতেলদের কাছে থেকে’ রক্ষা করতে চাওয়ার কথাও বলেছেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের দুদিন পর মঙ্গলবার দলের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বনানীর কার্যালয়ে এক সভায় ভোটের ফলাফলের মূল্যায়ন করেন রাঙ্গাঁ।
মহাজোট থেকে এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে জাতীয় পার্টি, যা দশম সংসদ নির্বাচনের চেয়ে ১৪টি কম। তবে দলটির নেতারা জানিয়েছেন, তাদের আসন ২২টি, ইসি ‘ভুল করে’ লাঙ্গলের দুজনকে নৌকার বিজয়ী দেখিয়েছে।
দলের এই ফলাফলে অসন্তুষ্ট রাঙ্গাঁ বলেন, “আমরা সন্তুষ্ট নই, অনেক আসন পাওয়ার কথা ছিল।”
গণআন্দোলনের এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি বন্দি থাকা অবস্থায় ৩৫টি আসনে জিতেছিল জাতীয় পার্টি। এরপর ক্রমান্বয়ে আসন কমছে তাদের; যদিও তিন বার সরকারের অংশীদার ছিল তারা।
বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা এরশাদ দেওয়ার পর তিনি নাটকীয় অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দিক-নির্দেশনাহীন অবস্থায় ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেয় এবং অধিকাংশ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
এবার নির্বাচনের আগেও একই রকম অবস্থা হয়েছিল; মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর এরশাদ মহাসচিবের পদ থেকে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে রাঙ্গাঁকে বসিয়ে সিঙ্গাপুরে চলে যান চিকিৎসার জন্য। যাওয়ার আগে আবার বড় ক্ষমতা দিয়ে যান হাওলাদারকে।
মহাজোটে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী আসন না পাওয়ার পর ভোটের আগে ফিরলেও প্রচারে নামেননি এরশাদ। নিজে ঢাকার আসনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়ালেও মহাজোটের বাইরে দলের প্রার্থীদের ভোটের মাঠে থাকার নির্দেশ দেন তিনি। ভোটে মহাজোটের বাইরে দাঁড়ানো জাতীয় পার্টির দুই-একজনই কেবল বিজয়ী হতে পেরেছেন।
জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান এরশাদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য, শীর্ষনেতাদের অসহযোগিতায় এবার তাদের প্রচার ছিল ছন্নছাড়া। ভোটের দুদিন আগে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসেও তারা কোনো জ্যেষ্ঠ নেতার দেখা পাননি।
রাঙ্গাঁ বলেন, “আমরা যদি ৯০ তে ভুলটা না করতাম, ৯৬ তে যদি ভুলটা না করতাম, এমনটি ২০১৪ তেও না করতাম .... বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ভুল হয়ে গেছে। এবারও ভুল করলাম।
“রাজনীতির একটা ভুল, ৫ বছর পরও মাশুল দিতে হয়। নির্বাচনে আমরা যে ভুলগুলো করলাম, এর মাশুল আমাদের আরও ৫ বছর দিতে হবে।”
১৯৯১ সাল থেকেই জাতীয় পার্টির নেতারা দল ছাড়ছেন। এই নির্বাচনের আগেও কজন চলে যান।
সে কথা মনে করে রাঙ্গাঁ বলেন, “স্যার (এরশাদ) তো কোনোদিন কারও উপর রাগ করেন নাই। তবে অনেকে অনেক সময় অনেক কিছু করে ফেলেন, নেতাকর্মীরা রাগ করে দল থেকে চলে যায়।
“আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবের সময় থেকে দলটায় যদি সবাইকে ধরে রাখতে পারতাম..... সবাই আমাদের থাকত, আমরাই বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকতাম।”
“এখন আঁতেলদের কাছ থেকে দলটাকে রক্ষা করতে হবে আমাদের সবাইকে,” বলেন তিনি।
নির্বাচনের আগে হুট করে দলের সদস্যপদ দেওয়ায়ও বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব।
“নির্বাচনের তিন মাস আগে কেউ এসে বলল, আমি দলে এই কন্ট্রিবিউট করতে চাই, আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হোক। দলের অনেকে বলেন, তাকে মনোনয়ন দেওয়া হোক,তাকে দিলেই তো ভালো হয়। এই পরিণতিতে দলটি এ অবস্থায় চলে এসেছে। সুতরাং এগুলো বন্ধ করতে হবে।”
জাতীয় পার্টিকে ‘ধ্বংস’ করতে কারও কারও ভূমিকার কথা যখন তৃণমূলের কর্মীরা বলছেন, তাতে সায় দেন রাঙ্গাঁও।
“একটা দলকে ধ্বংস করতে খুব বেশি লোকের প্রয়োজন হয় না। ক’জন সংসদ সদস্য যদি উলটপালট কিছু করে দেয়, তাহলে কিন্তু একটা সমস্যা তৈরি হয়ে যায়।”
ভোটের পরদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথায় প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গাঁ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি জানালেও মঙ্গলবারের সভায় এসে নানা অনিয়মের কথা বলেন।
তিনি বলেন, “বিএনপির উপর যে অন্যায়-অত্যাচার হচ্ছে। অনেক জায়গাতে তারা এত বেশি নিগৃহীত হয়েছে, এত বেশি মামলা, তাদের উপর হয়েছে, সে পরিমাণ আমাদের উপর হয় নাই।”
বিএনপির মতো ‘অত্যাচারিত’ না হওয়ায় জাতীয় পার্টি ‘সুবিধাজনক অবস্থানে আছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় পার্টি এবারও বিরোধী দলে গেলে ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে’ সরকারের বিরোধিতা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন রাঙ্গাঁ।
সভায় বক্তব্যের পর জাতীয় পার্টি মহাসচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “জাতীয় সংসদে আমরা ছায়া সরকারে রূপান্তরিত হতে পারি।”
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “সরকারি দলের এমন কিছু সংসদ সদস্যের নাম শুনি আমরা, যাদের কথা শুনলে আঁতকে উঠি। এসবের পর তো সারা বাংলাদেশে মানুষ যখন একসঙ্গে হয়ে যাবে, তখন তারা বিরোধী দল মানে আমাদের ভোট দেবে।”
তিনি বলেন, “ভোট কম বেশি পাই, সেটা আলাদা কথা। এবারের অভিজ্ঞতা তিক্ত হোক, অভিজ্ঞতা লাভ করা দরকার। এই সরকারের অবস্থান যে এরকম থাকবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নাই।”
তিনি জানান, জাতীয় পার্টি এবার সরকারে যাবে, না কি বিরোধী দলে থাকবে সে সিদ্ধান্ত নিতে সভাপতিমণ্ডলী বুধবার বৈঠক করবে।
এই সভার সিদ্ধান্তের পর মহাজোটে আলোচনা শেষে চূড়ান্তভাবে জানা যাবে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান।