বিএনপির ভরাডুবির কারণ দেখালেন শেখ হাসিনা 

আওয়ামী লীগের অভাবনীয় জয় এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবির কারণ বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2018, 04:35 PM
Updated : 1 Jan 2019, 02:28 AM

তিনি বলেছেন, নেতৃত্বহীনতা, প্রার্থীদের নিস্ক্রিয়তা ও মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে যোগ্যদের বাদ পড়ার কারণে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বিরোধী জোটের।

অন্যদিকে পরপর দুই মেয়াদে সরকার গঠন করে দেশের মানুষের জীবন-মান ও অবকাঠামোর উন্নয়নের কারণে জনগণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে ভরসা রেখে বিশাল জয় এনে দিয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।

সংসদ নির্বাচনের পরদিন সোমবার বিকালে গণভবনে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আসা ১১ জন পর্যবেক্ষক ও ৪০ জন বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী; তাদের নানা প্রশ্নের উত্তরও তিনি দেন।

রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট একচেটিয়া জয় পেয়েছে। ৩০০ আসনের ২৫৯টিতেই জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, মহাজোট পেয়েছে ২৮৮ আসন। এই নিরঙ্কুশ জয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র সাতটি আসনে জয়ী হতে পেরেছে। কারচুপির অভিযোগ এনে ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।

ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

শেখ হাসিনার কাছে বিরোধী জোটের এই ভরাডুবির কারণ জানতে চান এক বিদেশি সাংবাদিক।

জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “বিএনপি তাদের দোষেই মাত্র সাতটা সিট পেয়েছে। এখানে আমাদের কোনো ফল্ট নেই।”

সেনা ছাউনীতে বিএনপির প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তাদের জন্ম হয়েছে একজন সামরিক শাসকের হাতে। তাদের প্রধান সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী। জনগণ তাই তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বহীনতা নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাবান নারী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া শেখ হাসিনা।

“আপনারা কি তাদের মধ্যে কোনো নেতৃত্ব দেখেছেন?”

তিনি বলেন, দুর্নীতির দায়ে বিএনপির নেত্রী কারাগারে। তারা আরেকজনকে চেয়ারপারসন মনোনীত করেছে যে শুধু সাজাপ্রাপ্তই নয়, পলাতকও। যদি কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন করে যেখানে তাদের নেতা পলাতক, তখন তাদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়?

খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে এবার বিএনপি কামাল হোসেনকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ভোটের লড়াইয়ে এসেছিল।

জোটের শীর্ষনেতা কামাল নির্বাচনে অংশ নেননি। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে থাকে, তারা ক্ষমতায় গেলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? ঐক্যফ্রন্ট নেতারা এ প্রশ্ন সবসময়ই এড়িয়ে গেছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে যখন কোনো দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তখন জনগণ তাদের কাছ থেকে কী দেখতে চায়? কে হবে সরকারপ্রধান। তারা তো কাউকে দেখাতে পারেনি।

আওয়ামী লীগের এক সময়ের নেতা কামাল হোসেন সরাসরি ভোটে কখনও জয়ী হতে পারেননি। ১৯৭৩ সালে উপনির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া আসনে বিজয়ী হন তিনি। ১৯৯১ সালের পর তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে গণফোরাম নামে নতুন দল গঠন করেন। গণফোরাম থেকে ১৯৯৬ সালে ভোটে দাঁড়ালেও তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।

একথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তার কোন দল পরিচালনার অভিজ্ঞতা বা ভোট পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। এটা তাদের প্রধান সমস্যা।”

ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্যের বিষয়টি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “প্রতি আসনে তারা চার থেকে পাঁচজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। এরপর তারা সিট অকশন করে।”

এই ‘অকশন’র কারণে বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীও বিএনপি থেকে বাদ পড়ে যায়, বলেন তিনি।

“বিজয়ী হতে পারবে এমন অনেকে প্রার্থী হওয়ার জন্য দলের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন। ধামরাইয়ে জিয়াউর রহমান, নারায়ণগঞ্জ তৈমূর আলম খন্দকার, সিলেটে ইনাম আহমেদ চৌধুরীর বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাননি।

“তারা প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বানিজ্য করেছে। তাহলে আপনি তাদের কাছ থেকে কী আশা করবেন?”

বিএনপি থেকে যাদের প্রার্থী করা হয়েছে তারা ভোটের লড়াইয়ে পরিশ্রম না করে ‘আয়েশে’ থেকেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“আমরা এটা দেখে খুবই আশ্চর্য হয়েছি যে, তারা (বিএনপির প্রার্থীরা) খুব আয়েশে আছে এবং কোনো ধরনের অ্যাক্টিভিটিজ নেই। শুধু কয়েকজন প্রার্থী সক্রিয় ছিল। এটা আমাদের খুবই অবাক করেছে এবং এর আগে কখনও প্রার্থীকে এভাবে বসে থাকতে আমরা দেখিনি।”

বিএনপির প্রার্থীরা ‘শুধু মোবাইল ফোনে ভোট করেছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, হয়ত তারা অংশ নিয়ে নির্বাচনটাকে অগ্রণযোগ্য করতে চেয়েছিল। অথবা তাদের অন্য কোনো দুরভিসন্ধি ছিল।

“কারণ ষড়যন্ত্র তাদের চরিত্রে রয়েছে।”

ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

শেখ হাসিনা বলেন, “এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, কেন মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে? আমি প্রশ্ন করবো কেন নয়?”

আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ভাষায়, দীর্ঘদিন পর দেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে যে, তারা সুবিধাভোগী। জনগণ সুবিধাভোগী কারণ, সরকার তাদের জন্য সব ধরনের কাজ করেছে, সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, সামাজিক সুরক্ষা দিয়েছে, অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছে, ডিজিটাল সুবিধা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক সম্প্রসারণ করেছে।

এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি করা, দারিদ্র্য বিমোচনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়া, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, মাথাপিছু আয় সাড়ে সতেরশ ডলারে উন্নীত করা, সরকারি কর্মচারী ও পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

“শুধু শহর না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গ্রাম পযন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, যুব সমাজের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য কেউ পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশে কোনও ঘরহীন মানুষ থাকবে না। বিনামূল্যে ঘর করে দিচ্ছি।”

মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা একমাত্র তার নেতৃত্বাধীন সরকারই দিয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তারা অবশ্যই আমাদের ভোট দেবে। আমরা তাদের জন্য অনেক করেছি। তাই, তাদের কাছ থেকেও আমরা সমর্থন পাচ্ছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, “এর পাশাপাশি আপনি যদি বিরোধীদের দিকে তাকান, তারা কারা? ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে।

“মানুষ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে বর্জন করেছে। আপনি যদি দেখেন, মানুষ মনে করছে এই দল (বিএনপি) একটি সন্ত্রাসী দল। তাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির কথাও সবার জানা। আর একারণে তারা এদেশের কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি।”

নির্বাচনে সহিংসতার বিষয়ে তিনি বলেন, “তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক ছিল তাই তারা সফল হতে পারেনি।

কয়েকটি জায়গায় সহিংসতায় ঘটলেও নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলেই শেখ হাসিনা মনে করেন। অনুষ্ঠানে থাকা পর্যবেক্ষকরাও বলেন, তাদের চোখে ভোট ছিল অবাধ ও শান্তিপূর্ণ।

ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সরকারের ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকার কী হবে?

শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের অগ্রাধিকার যেটা হবে, আমরা যেসব প্রকল্প ইতোমধ্যে নিয়েছি সেগুলো বাস্তবায়ন করা। আর এখন যেটা মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিরাপদ ও সুরক্ষা দেওয়া।

“আমরা নির্বাচনের রায় মেনে নিয়েছি এবং দেশের উন্নয়ন চালিয়ে যাওয়ার দারুণ সুযোগও এসেছে। এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের দেশের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

গত ১০ বছরে মানুষের জীবন-মানের যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে তা আগামী পাঁচ বছরে আরও গতি পাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব না। তাই আমি মনে করি সস্মৃদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকতে হবে।

“আর এখানে (বাংলাদেশে) কোনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদকের ব্যবহার ও দুর্নীতি হতে দেওয়া হবে না। এগুলো আমাদের সমাজের প্রধান শত্রু। আমরা সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছি। মানুষকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব আমরা।”

ভোট শুরুর আগেই ব্যালটবক্সের মধ্যে সিল মারা ব্যালট থাকা একটি ভিডিও সম্প্রচারিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বিবিসির এক সাংবাদিক ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ওই ছবি ‘এই নির্বাচনের না’।

তার ধারণা, এটা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ছবি, যেখানে গণনার জন্য ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে বিশ্বাস করেন না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এটা ‘অতিরঞ্জিত এবং পুরনো’ ছবি।

“যখনই কোনো অভিযোগ গিয়েছে তখনই নির্বাচন কমিশন সেখানে ভোট বাতিল করেছে। এরকম কিছু ঘটে থাকলে সেখানে স্থগিত হয়ে যেত।”

বিরোধীদের মাত্র সাতটি আসন পাওয়া নিয়ে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন বিজেপি মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল।

আবার ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির বিষয়টিও ওই সাংবাদিককে মনে করিয়ে দেন শেখ হাসিনা।

সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ এ আরাফাতের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমাম। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীও অনুষ্ঠানে ছিলেন।

পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কানাডা, নেপাল, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ও ওআইসি, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের মধ্যে বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ছিলেন।