পরিকল্পিত ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’: ফখরুল

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল আগেই সাজিয়ে রাখা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2018, 02:35 PM
Updated : 31 Dec 2018, 02:35 PM

ফল প্রত্যাখ্যানের পর এখন বিএনপির কর্মপন্থা কী, তা স্পষ্ট করেননি তিনি।

ভোটে ভরাডুবির পরদিন সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ‘সময়মতো’ জানাবেন তারা।

“আমরা সমস্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নেব। এজন্য জোটের সাথে আলাপ করে ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করব।”

দাবি আদায়ে ‘আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি আন্দোলন’ও চলবে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “অবশ্যই আমাদের কর্মসূচি থাকবে।”

যারা নির্বাচিত হয়েছেন- ভোট প্রত্যাখ্যানের পর তারা এখন শপথ নেবেন কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, “আমরা ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি।”

ফখরুল বলেন, “এই নির্বাচন পূর্ব পরিকল্পনায় হয়েছে। আর ইঞ্জিনিয়ারিংটা করা হয়েছে, ভোটের আগের রাতে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। এই কারণে জনগণ যে ১০ বছর ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারছিল না, সেটা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হল।”

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পুনঃভোটের দাবি নাকচের প্রতিক্রিয়ায় সিইসি নূরুল হুদাকে ‘দলীয় ব্যক্তি’ আখ্যায়িত করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পুনরায় জানান বিএনপি মহাসচিব।

রোববার একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পর ফল ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনঃভোটের দাবি জানায় বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

রাতে ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, ২৯৮টি আসনের মধ্যে কেবল ৭টিতে জিতেছে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ২৮৮ আসন জয়ের বিপরীতে অধিকাংশ আসনে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে ধানের শীষের প্রার্থীদের।

নির্বাচনের পরদিন গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন ফখরুল।

ঘোষিত ফল বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে একেবারে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আমাদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে নজিরবিহীনভাবে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে ত্রাস-ভীতি সৃষ্টি করে এই নির্বাচনটি করা হয়েছে।

“এই নির্বাচনকে ভোট ডাকাতি বলা যেতে পারে, এই ভোট ডাকাতির ফলে আমরা এই নির্বাচনের ফলাফলকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা মনে করি, এই কলঙ্কজনক নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় অনুষ্ঠিত করতে হবে এবং এটা অনতিবিলম্বে করতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা সোমবারই বলেছেন, নতুন করে নির্বাচনের সুযোগ নেই।

এর প্রতিক্রিয়ায় ফখরুল বলেন, “বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সবচাইতে পক্ষপাতদুষ্ট একজন ব্যক্তি এবং আপনারা জানেন, প্রথম থেকে তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছিলাম। তিনি একজন দলীয় ব্যক্তি, তার সমস্ত কার্যকলাপ ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে।

“উনি যেভাবে কথা বলেন তাতে সম্পূর্ণভাবে সরকার যে কথা বলতে চায় তার প্রতিধ্বনি করেন। সে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন।”

ফখরুল বলেন, “নতুন ভোটাররা এবার সবচাইতে বেশি ডিপরাইভড হয়েছেন। তাদের যে অধিকার সেই অধিকার তারা প্রয়োগ করতে পারেননি। রাজধানীসহ প্রত্যেকটি কেন্দ্র ভোটারশূন্য ছিল।”

“এই নির্বাচনে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে দলীয় সরকারের অধীনে কখনও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না,” বলেন তিনি।

“এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত ছিল, সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলে। অর্থাৎ আমরা যেটা বলে আসছি যে দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি আছে সেই সংস্কৃতিতে এখানে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব নয়।”

নির্বাচনে কেন?

সংশয় থাকলেও নির্বাচনে কেন অংশ নিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরও সংবাদ সম্মেলনে দেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “অনেকে প্রশ্ন করেছেন, এত গ্রেপ্তার-হামলার পর নির্বাচনে আমরা কেনো গেলাম?

“তখনও বলেছি, এখনও স্পষ্ট করে বলছি, আমরা গণতন্ত্র বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল। আমরা নির্বাচন করতে চাই, নির্বাচন করে সরকার পরিবর্তনে বিশ্বাসী। সেই কারণে আমরা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা নির্বাচনে গিয়েছি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

“নির্বাচন কমিশনকে বার বার বলে এসেছি, আপনি একটা পরিবেশ তৈরি করুন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করুন। আপনারা জানেন যে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের কাছে গিয়েছিলাম নির্বাচনের একটা পরিবেশ তৈরি করতে। কিন্তু তারা সেটা করতে পারেনি।”

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এপর্যন্ত ২১ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অভিযোগ করে অবিলম্বে তাদের মুক্তির দাবিও জানান ফখরুল।

সিইসির বক্তব্যের প্রতিবাদ

বিএনপির এজেন্ট নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের জবাবে ফখরুল বলেন, “উনি (সিইসি) বলেছেন, এজেন্ট না আসলে আমি কী করব? আরে এজেন্ট না আসতে দিলে আমরা (বিএনপি) কী করব? এজেন্টকে তো আপনারা আসতেই দেননি।

“এই সরকার তার রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও নির্বাচন কমিশনের যোগসাজসে আমাদের এজেন্টদেরকে কেন্দ্রে যেতেই দেননি। যেমন আমার নির্বাচনী এলাকায় একশ ভাগ এজেন্ট ছিল, কিন্তু তাদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

“আমাদের দলের নেতা গয়েশ্বর বাবুর (ঢাকা-৩) ওখানে একশ ভাগ এজেন্ট ছিলে, তাদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাহেবের নির্বাচনী এলাকায় এজেন্ট ছিলে, তাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে।”

ভোট পরবর্তী সহিংসতার অভিযোগ

ভোটের পর বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীনরা সহিংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগে সহিংসতা হয়েছে, নির্বাচনের দিন হয়েছে। এখন ভোটের পরে পরেই শুরু হয়েছে সহিংসতা।

“বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রমন চালানো হচ্ছে, নেতা-কর্মীদের বাড়িতে আক্রমণ চালানো হচ্ছে, বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

নিজের নির্বাচনী এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি ইউনিয়নের দানারহাট কেন্দ্রে বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেন ফখরুল।

“নির্বাচনের দিন ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ কেন্দ্রে আমার প্রধান এজেন্টের বাড়িতে আক্রমণ করে ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমার স্ত্রীকে ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হয়নি। আমি নিজে গিয়ে ওই কেন্দ্র দেখেছি, ৪/৫ টা বুথে কোনো এজেন্ট নেই। ভয়ভীতি তৈরি করা হয়েছে, যাতে কেউ না আসে।”

দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে ছিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিকাল ৪টা থেকে দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন। এরপর ২০ দলীয় জোটের বৈঠকও হয় সেখনে। এতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। বৈঠকে এলডিপির অলি আহমদ বাদে জামায়াতসহ জোট শরিক দলগুলোর নেতারা ছিলেন।