এখন কী করবে বিএনপি, উত্তর খুঁজছেন কর্মীরা

খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে কারাগারে যাওয়ার পর গভীর সঙ্কটে পড়া বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট গড়ে সুদিনে ফেরার স্বপ্ন দেখলেও নির্বাচনে হেরে দলটির কর্মীদের এখন দিশা হারানোর দশা।  

সুমন মাহমুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2018, 12:51 PM
Updated : 31 Dec 2018, 12:51 PM

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারে বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য, ‘গণতন্ত্রের’ মুক্তির জন্য ভোট চেয়েছিলেন। কিন্তু রোববারের নির্বাচনের ফলাফল তাদের জন্য নিয়ে এসেছে আরও বড় বিপর্যয়।      

বিএনপির মাঝারি ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কথায় সেই হতাশা আর অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট। তাদের জিজ্ঞাসা- এখন কী করবে বিএনপি?

তাদের ভাবনাটা এমন যে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ফল কেমন হতে পারে তা আগেই বোঝা উচিত ছিল নেতাদের।

তফসিল ঘোষণার পরও সারা দেশে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার- হয়রানির অভিযোগ জানিয়ে আসা বিএনপি আশা করেছিল, সেনা মোতায়েনের পর পর পরিস্থিতি বদলাবে, তাদের ভাষায়, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হবে।

কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীকে ‘স্বাধীনভাবে’ কাজ করতে দিচ্ছে না বলে ভোটের আগেই অভিযোগ করা হয় দলটির পক্ষ থেকে।

সেনা মোতায়েনের পরও যখন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভোটের প্রচারে হামলা-সহিংসতার খবর আসছিল, তখন বিএনপি নেতারা ভোটের ভবিষ্যত বুঝতে পারছিলেন কি না- সেই প্রশ্নও উঠেছে কর্মীদের মধ্যে।

এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জবাব দিতে গিয়ে ব্রিবত হয়েছেন তারা।

রোববার অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেখানে ২৫৯ আসনে জয় পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় যাচ্ছে, সেখানে বিএনপি ও তাদের শরিকরা মিলে আসন পেয়েছে সাতটি।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত দশ মাস ধরে কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন এক যুগ ধরে। তিন মামলায় সাজার রায় মাথায় নিয়ে তারেকের ফেরার কোনো আশা বিএনপিকর্মীরা দেখছেন না।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে স্থায়ী কমিটির নেতাদের নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই কার্যত দল চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে মাত্র পাঁচটি আসন পাওয়া বিএনপির সামনে এখন প্রধান বিরোধী দল হওয়ারও আশা নেই।

ভোটের পর রোববার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক কামাল হোসেন একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুণঃভোটের দাবি জানান।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এ নির্বাচনকে একটি ‘ভয়ংকর প্রহসন’ বলে প্রত্যাখান করেন।

এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে সোমবার বৈঠকে বসেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। ২০ দলীয় জোট এবং ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গেও তাদের বৈঠক হবে। কিন্তু এত অল্প আসন নিয়ে সংসদে যাওয়ার প্রশ্নে দ্বিধা-বিভক্ত বিএনপি নেতারা।

তাদের এক পক্ষের মত হল, এত কম শক্তি নিয়ে সংসদে গিয়ে তারা কোনো কথাই বলতে পারবেন না। মূলতবি কিংবা মনোযোগ আকর্ষণী নোটিসেরও জবাব তারা পাবেন না।

আরেক পক্ষের মত ভিন্ন। তাদের ভাষায়, বিএনপিকে যেভাবে ‘সাজানো নির্বাচনে হারানো হয়েছে’ তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সংসদে না গিয়ে এর সমাধান আসবে না।

বিএনপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের মাঠ পর্যায়ের কর্মী মুহাম্মদ শফিক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেনা মোতায়েনের পরদিন সেভাবে নির্বাচনী সহিংসতা হয়েছে, প্রার্থীসহ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের হিড়িক পড়েছে, তখনই দলের নেতাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা জরুরি ছিল। সেটা না করে এভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে আমি মনে করি।”

নির্বাচন থেকে সরে গেলে বিএনপিকে সমালোচনায় পড়তে হত, তাতে ঝুঁকি আরও বাড়ত কি না- সে প্রশ্নের জবাবে যুব দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা আফজাল চৌধুরী বলেন, “যখন দেখলেন নির্বাচন কমিশন কোনো কিছুই করছে না, সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়নি- তখনই আপনাকে বুঝতে হবে ঘটনা কোন দিকে এগোচ্ছে। সেই জায়গায় নেতারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমি মনে করি।” 

২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর গত দশ বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে সাফল্য পায়নি বিএনপি। বরং দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে ছিটকে যায় সংসদের বাইরে।

পরপর দুই জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে হত বিএনপিকে। ফলে এবারের ভোট এড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সামনে।

তারপরও কর্মীদের ভাবনা যে বিএনপি মহাসচিবের মাথাতেও খেলে গেছে, রোববার ভোটের পর তার কথায় তা স্পষ্ট হয়।

ঐক্যফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “অনেকে মনে করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়াটা ভুল ছিল, আজকের নির্বাচন প্রমাণ করল যে, সেটা ভুল ছিল না।”

ফখরুলের ভাষায়, এই নির্বাচন ছিল গোটা জাতির সঙ্গে ‘ক্রুয়েল মকারি’, ‘সাজানো নাটক’।

বিএনপির যে পাঁচ প্রার্থী নির্বাচনে জয়ের দেখা পেয়েছেন, তারা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন কিনা- সে প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তার আগে কারাগারে গিয়ে দলের চেয়ারপারসনের নির্দেশনা নেবেন তারা। 

সামরিক শাসক থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ছয়টি রাজনৈতিক দল ও মতের অনুসারীদের এক মঞ্চে নিয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি’ গঠন করেন। এ দলের ৪০ বছরের ইতিহাসে ৩৪ বছরের বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়াই বিএনপির চেয়ারপারসন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুই মেয়াদে দশ বছর দেশ শাসন করে, আরও দুইবার তারা সংসদে ছিল বিরোধী দলের আসনে। গত ফেব্রুয়ারিতে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় খালেদার ৫ বছরের সাজার রায় হলে দলটি বড় ধাক্কা খায়। তখনই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান তার ছেলে তারেক রহমান, যিনি আদালতের দৃষ্টিতে একজন পলাতক আসামি।

গত সেপ্টেম্বরে বিএনপির ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন বিএনপি নেতারা।

কিন্তু রোববারের ভোটে তাদের বড় পরাজয়ের পর সরকারের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বিএনপি এখন মুসলিম লীগের পরিণতির দিকে এগোচ্ছে।