এবার নেতাকর্মীদের নিয়ে কাঁদলেন মির্জা ফখরুল

বেশ কয়েকবার বক্তব্যের মধ্যে কান্নাকাটি করে আলোচিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কুমিল্লায় এক দলীয় প্রার্থীর জন্য ভোট চাইতে গিয়েও কেঁদে ফেললেন, তার আবেগ দেখে কেঁদে ফেললেন নেতাকর্মীরাও।

সুমন মাহমুদকুমিল্লা থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Dec 2018, 02:15 PM
Updated : 19 Dec 2018, 03:04 PM

বুধবার বিকালে কুমিল্লার সুয়াগাজী পুরাতন হেলিপ্যাড মাঠে কারাবন্দি নেতা মনিরুল হক চৌধুরীর পক্ষে নির্বাচনী সভায় আবেগ প্রবণ হয়ে ওঠেন বিএনপি মহাসচিব।

মনিরুলের মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসকে পাশে রেখে তার এই কান্না ছুঁয়ে যায় মাঠের নেতাকর্মীদের, তাদের অনেককে কাঁদতে দেখা যায়।

কান্না জড়িত কণ্ঠে মির্জা ফখরুল বলেন, “এই যে আমার মেয়ে শাম্মী। এতো কথা বলেছে কার জন্যে? তার তো আজকে জনসভায় কথা বলার কথা নয়। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, তার গবেষণা করার কথা, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর কথা। বাবার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে।

“আমি আজকে আপনাদের সকলের কাছে একটা করে ভোট ভিক্ষা চাইব। আমার হৃদয়ের বন্ধু মনিরুল হক চৌধুরী মুক্তির জন্য একটা ভোট ভিক্ষা চাচ্ছি, আমি একটা ভোট ভিক্ষা চাচ্ছি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য, আমি ভোট চাচ্ছি কারাবন্দি নেতা গফুর ভুঁইয়া ও মোবাশ্বের আলী ভুঁইয়ার মুক্তির জন্য।”

সমবেতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনাদের যে ভাইরা এখানে সামনে যে ছোট ছোট ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে অনেকে ঢাকায় রিকশা চালায়। এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা পালিয়ে থাকে ছেলেরা, হকারি করে তারা। এটা কি আমাদের স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা, এটা কি স্বপ্ন? আমাদের স্বাধীনতার সমস্ত স্বপ্নকে চুরমার করে খান খান করে দিয়েছে এই আওয়ামী লীগ।”

প্রকাশ্য সভায় মির্জা ফখরুলের কান্নার শুরু নেতাকর্মীদের অনেকের এই পরিস্থিতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে। ২০১৬ সালের অগাস্টে ঢাকায় এক আলোচনা সভায় ওই কথা বলার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিএনপি মহাসচিব।

এরপর ঢাকা ও নিজের এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ে একাধিক জনসভায় কেঁদেছেন ফখরুল। সর্বশেষ গত ১২ ডিসেম্বর নিজের আসনে নির্বাচনী সভায় ভোট চাইতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি।

এর আগে কোথাও মঞ্চের অন্য কোনো নেতাকে ফখরুলের সঙ্গে কাঁদতে দেখা যায়নি। এদিন প্রার্থী মনিরুলের মেয়ে চৌধুরী সায়মাও তার সঙ্গে কাঁদতে থাকেন।

পরে কাঁদতে কাঁদতে চৌধুরী সায়মা সভায় বলেন, “আমার বাবা মনিরুল হক চৌধুরীকে অন্যায়ভাবে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। ৩০ তারিখ এর জবাব দিতে হবে ধানের শীষে ভোট দিয়ে। কুমিল্লার ছেলেরা মার খাচ্ছে তাদের মুক্তির দাবিতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন।

“৩০ তারিখ একসঙ্গে ভোট দিতে প্রস্তুতি নিন। আমি আপনাদের পাশে থাকব।”

নির্বাচনী সভায় বিএনপি মহাসচিবের এভাবে কান্না দৃষ্টি কেড়েছে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের। বুধবারই নিজের এলাকা নোয়াখালীতে এক সভায় বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “কান্নাকাটি বা চোখের পানিতে ভোট আসে না।”  

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও নাঙ্গলকোট উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-১০ আসনে মনিরুলের প্রধান প্রতিপক্ষ নৌকার প্রার্থী পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

আওয়ামী লীগ নেতা কামালের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “হুমকি দিয়ে বলে এখানে (কুমিল্লা-১০) ২৭ তারিখ থেকে নাঙ্গলকোটে আর কোনো বিএনপি থাকবে না। আমি বলি আপনি কে? আপনি কি জমিদার? আপনি কি রাজা? এই কথা বলার আপনি কে?

“এই মাটি আমাদের, এই দেশ আমাদের, এখানে সবাই থাকব। ভোট দেব ৩০ ডিসেম্বর, ধানের শীষে ভোট দিয়ে মনিরুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী করে আপনাকে এখান থেকে বিদায় করব।”

নাঙ্গলকোট থানার ওসি নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ তুলে তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান মির্জা ফখরুল।

কারাবন্দি মনিরুল হক চৌধুরীর প্রতি ‘অনশন’ ভাঙার আহ্বান তিনি বলেন, “মনিরুল হক চৌধুরী জেলখানায় ১২ দিন ধরে অনশন করছেন। কেন? তাকে তার নেতা-কর্মীদের সাথে দেখা করতে দেয় না। তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, নির্বাচনে কোনো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।

“আমি এই মঞ্চ থেকে আহবান জানাতে চাই, আপনি কার কাছে দাবি জানাবেন? এদের তো কানে মোহর দিয়ে দিয়েছে আল্লাহ। এরা কিছু শুনতে পায় না, বধির। এদের বুকের মধ্যে কোনো দয়া-মায়া নেই, মানুষের জন্য মন কাঁদে না। আমি বলছি, এখানে লাখো মানুষ অনুরোধ জানাচ্ছে দয়া করে আপনি অনশন ভঙ্গ করুন, এদেশের মানুষের জন্য আপনি বেঁচে থাকুন।”

আওয়ামী লীগকে সরাতে অন্যান্য দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, “যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন আজকে তারা এক হয়েছেন। আজকে বুঝতে হবে, জানতে হবে এখানে ধানের শীষকে জয়ী করতে না পারি তাহলে মনিরুল হক চৌধুরী বের হবেন না, গফুর ভুঁইয়া বের হবেন না, মোবাশ্বের আলী ভুঁইয়া বের হবেন না, হাজারো নেতাকর্মী যাদের মিথ্যা মামলায় জেলে রাখা হয়েছে, তারা কেউ বের হবেন না।

“সবচেয়ে বড় আমাদের গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন না। ফিরিয়ে আনতে পারব না আমাদের নেতা তারেক রহমানকে।”

সেজন্য যত বড় সমস্যাই হোক না কেন ভোট পর্যন্ত মাথা নত না করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটের লড়াইয়ে নামা কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, “আগামী ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তির দিন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর মানুষের মুক্তির দিন। একজন এই সময়ে বললেন, আপনি বঙ্গবন্ধুকে মনে করে রাজনীতি করেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা একটা ভোটের জন্য মানুষকে মারে।

“আপনাদের বলতে চাই, আলেমের ঘরেও জালেম হয়।”

একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যাওয়ায় কাদের সিদ্দিকী, কামাল হোসেন ও মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সমালোচনা করছেন শেখ হাসিনা।

তার জবাব দিতে গিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেন, “তারা বলে তারা নাকি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। আমি বলছি, আমরা স্বাধীনতার পক্ষে নয়, আমরাই স্বাধীনতা। যেখানে জিয়াউর রহমান আছে, যেখানে ড. কামাল হোসেন আছেন, যেখানে আ স ম আবদুর রব আছেন, যেখানে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আছেন, যেখানে মান্না আছে, সেখানে কি পক্ষ লাগে? আমরাই স্বাধীনতা।”

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কথা ভেবে সবাইকে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান কাদের সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে সারা দেশে ধানের শীষের প্রার্থী একজনই। তিনি হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। মনিরুল হক চৌধুরী, আমাদের মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী- এরা ধানের প্রতীক মাত্র।”

চান্দিনার নির্বাচনী সভা শেষ করে কুমিল্লা-১০ আসনের এই সভায় যোগ দেন বিএনপি মহাসচিব। এই আসনের প্রবেশপথ থেকে মটরসাইকেল শোভাযাত্রাসহ মির্জা ফখরুলের গাড়ি নিয়ে আসা হয় সুয়াগাজীর চৌয়ারায় মনিরুল হক চৌধুরীর বাসায়। সেখানে দুপুরে খাবার খেয়ে নির্বাচনী সভায় আসেন ফখরুল।

সুয়াগাজীর চৌয়ারায় রাস্তার দুই পাশে মনিরুল হক চৌধুরীর ছবি সম্বলিত পোস্টার দেখা গেছে। এ রকম পোস্টার চান্দিনায় ধানের শীষের প্রার্থী রেদোয়ান আহমেদের নির্বাচনী এলাকায় দেখা গেছে।

এই নির্বাচনী সভায় দলের কেন্দ্রীয় নেতা কামরুজ্জামান রতন, মিয়া মোস্তাক আহমেদ, আবদুল আউয়াল খান, শামসুদ্দিন দিদার, মইনুল ইসলাম বাবুল, শহিদুজ্জামান মজুমদার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।