জিয়া-খালেদা-এরশাদ মানুষের সম্পদ লুটে খেয়েছে: শেখ হাসিনা

পঁচাত্তরের পনের অগাস্টের পর বিভিন্ন দফায় ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও ‍হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনগণের সম্পদ ‘লুটেপুটে খেয়েছে’ বলে অভিযোগ করেছেন শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2018, 03:49 PM
Updated : 13 Dec 2018, 04:50 PM

বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে নির্বাচনী সমাবেশে একথা বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও ‍হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কখনো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ‘বিশ্বাস করেন না’।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আজকে আমরা যে উন্নয়ন করেছি, জিয়াউর রহমান-এরশাদ-খালেদা জিয়া পারে নাই। কেন পারে নাই?  কারণ এরা স্বাধীনতা বিশ্বাস করে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাস করে না।

“এরা মানুষের মঙ্গল জানে না, নিজেরাই শুধু ভালো থাকতে জানে। মানুষের সম্পদ লুটেপুটে খায়। নিজেরা সাজুগুজু করে বেড়ায়। এটাই তাদের কাজ। তারা দেশের মানুষের কল্যাণ চায় না।”

২০০১ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ ক্ষমতায় আসতে পারেনি মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ওই সময় ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশের অর্থ ‘বিদেশে পাচার’ করেছে।

“তখন ক্ষমতায় এল বিএনপি-জামাত জোট। আপনাদের মনে আছে, কীভাবে তারা দেশকে লুটে খেয়েছে? দেশের অর্থ মানুষের কাজে ব্যয় না করে নিজেরা ভোগ করেছে, বিদেশে পাচার করেছে।

“দুদকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় একটি ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম পরিচালনা করে 'নির্মাণ কনস্ট্রাকশন' কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে তারেক ও মামুন ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা টাকা নিয়ে তা সিঙ্গাপুরে পাচার করেন।”

পাটুরিয়া ঘাটে শেখ হাসিনার নির্বাচনী সভায় উপস্থিতদের একাংশ

২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানায় এই অভিযোগে তারেক রহমান ও তার বন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক।

এদিকে খালেদা জিয়ার আরেক ছেলে আরাফাত রহমান কোকোও সিঙ্গাপুরে অর্থপাচারের মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন।

ওই মামলায় বলা হয়, সায়মনের সহায়তায় কোকো অবৈধ উপায়ে অর্জিত ৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২ মার্কিন ডলার এবং ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬০৪ সিঙ্গাপুরি ডলার সে দেশে পাচার করেছিলেন।

এই প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “মানি লন্ডারিংয়ের জন্য খালেদা জিয়ার দুই ছেলে অভিযুক্ত হয়েছে আমেরিকার ফেডারেল কোর্টে। এফবিআই লোকেরা এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে।”

২০০৪ সালের একুশ অগাস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পাশাপাশি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও সাবেক সাংসদ আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

২০০৪ সালের ৭ মে টঙ্গীতে এক জনসভায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন আহসানউল্লাহ মাস্টার; ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে জনসভার পর বোমা হামলায় নিহত হন কিবরিয়া।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে উঠে আসে, ২০০৪ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামের সিইউএফএলের জেটিতে দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ার কথাও।

কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড ও দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয় বিএনপির তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে। এ বছরই একুশ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় বাবরসহ ১৯ জনের ফাঁসির রায় দেয় আদালত। ওই ঘটনায় দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

২০১৪-১৫ সালে সরকার উৎখাত আন্দোলনের নামে ‘বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাস’ করেছে বলেও অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “৩৯০০ মানুষকে অগ্নিসন্ত্রাসে তারা জ্বালিয়েছে। পাঁচশর মতো মানুষকে তারা হত্যা করেছে। ২০১৫ সাল থেকে পুরো তিন মাস, ৯২ দিন মানুষ হত্যা করেছে। কোনো সুস্থ মানুষ কোনো জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে? বলেন আপনারা। পারে না।

“অথচ তারা মানুষ হত্যা করে, ওটাই নাকি তাদের আন্দোলন। যাদের মানুষের প্রতি অতটুকু দরদ নেই, যারা মানুষের ভালো মন্দ বোঝে না, তারা ধ্বংস করা ছাড়া দেশের কাজ করতে পারেনি।“

দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘কোনো রাজনৈতিক কারণে বন্দি করা হয়নি’ বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “এতিমের নামে বিদেশ থেকে টাকা এসেছে। একটা এতিমও একটি টাকা পায়নি। নিজে দুই হাতে লুটপাট করেছে। দশ বছর মামলা করেছে। সে মামলায় আজকে সাজা পেয়েছে।”

গ্যাটকো ও নাইকো দুর্নীতি মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে আমেরিকা ও কানাডা প্রস্তুত আছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

ভিজিএফের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ, বয়স্ক-প্রতিবন্ধী-মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান, শিক্ষার বিস্তৃতির পাশাপাশি দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নানা উদাহরণ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই।”

শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, পাবর্ত্য শান্তি চুক্তির পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে লড়াইয়ে জয়ের কথাও উল্লেখ করেন।

২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত এক রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ সাড়ে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশকে দিয়ে ভারতের সঙ্গে নতুন সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দেয়।

শেখ হাসিনা বলেন, “জিয়া, এরশাদ ও খালেদা কেউ কিন্তু সমুদ্র সীমা নিয়ে পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা যে পাব, অর্জন করতে পারি, তা জানত না। দেশটাকেই চিনত না তারা। আমরা সরকারে এসে সমুদ্রসীমা নিয়ে কাজ শুরু করি।”

তিনি বলেন, সারা দেশে ৯০ ভাগ এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার পর আইসিটি বিভাগের অধীনে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষম করে গড়ে তুলছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে সারা দেশে ইন্টারনেট সুবিধা আরো বিস্তৃত করা হবে।

“সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। সমস্ত জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করেছি, মানুষের আয় বৃদ্ধি করেছি। উন্নয়নের জন্য যা যা করণীয় তা করছি।”

পাটুরিয়ার আগে দৌলতদিয়ায় নির্বাচনী সভায় রাজবাড়ীর দুই আসনের প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন শেখ হাসিনা

‘প্রয়োজন হলে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু’

নদী পার হওয়ার আগে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া বাসস্ট্যান্ডে এক নির্বাচনী সভায় শেখ হাসিনা বলেন, বলেন, “এই পদ্মা সেতু (মাওয়া-কাওড়াকান্দি) হওয়ার পর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করব।”

সেখানে রাজবাড়ী-১ আসনের নৌকার প্রার্থী কাজী কেরামত আলী এবং রাজবাড়ী-২ আসনের প্রার্থী মো. জিল্লুল হাকিমকে ভোটারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি।

এদিকে মানিকগঞ্জ থেকে সাভারের ধামরাইয়ে এসে হার্ডিঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে সভায় বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “ইনশাল্লাহ, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে, গ্রাম পর্যায়ে কোনো ঘর অন্ধকার থাকবে না, সারা বাংলাদেশের সব ঘরে আমরা আলো জ্বালাব।’

বিজয়ের মাসে ধামরাইবাসীর কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এই অঞ্চলের যারা জনগণ আছেন তাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে, বাংলাদেশে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করেছি, মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি; এখন বাংলাদেশকে সন্ত্রাস,দুর্নীতি, মাদক ও জঙ্গিবাদমুক্ত করতে আপনাদের সহযেগিতা চাই।”

দুই দিনের প্রচার অভিযানের সমাপ্তি

ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারের নামেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

বুধবার ঢাকা থেকে সড়ক পথে নিজের নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় পৌঁছে প্রথমেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও কবর জিয়ারত করেন শেখ হাসিনা। বিকালে কোটালীপাড়া উপজেলা সদরে শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজমাঠে নিজের প্রথম নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেন তিনি।

বৃহস্পতিবার সকালে টুঙ্গীপাড়া থেকে রওনা হয়ে বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সমাবেশ করে করে সড়কপথে ঢাকায় ফেরেন শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ফরিদপুরের ভাঙ্গা, ফরিদপুরের কোমরপুরে আব্দুল আজিজ ইনস্টিটিউশনে, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া বাসস্ট্যান্ডে, পাটুরিয়া ফেরি ঘাট প্রাঙ্গনে, মানিকগঞ্জ শহরের বাসস্ট্যান্ডে, ঢাকার ধামরাইয়ে হার্ডিঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ মাঠে এবং সবশেষে সন্ধ্যায় সাভারে নির্বাচনী সমাবেশ করে গণভবনে ফেরেন।

যাত্রাপথে বাজার ও সড়কে অসংখ্য মানুষ নৌকা মার্কার ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছ। তারা নৌকা মার্কা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে স্লোগান দেন। জনসমাগমস্থলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাড়ির গতি কমিয়ে নেতা, কর্মী, সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। কোথাও হাতে মাইক নিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চান।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, আফম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।