বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, ঘাতকের বুলেটে প্রাণহীন হলেও তার স্বপ্ন বয়ে চলার কথা জানিয়েছেন মেয়ে হাসিনা। তিন দফা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া এই রাজনীতিকের ভাষ্যমতে, যখনই দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারেন, তার মনে হয় তা দেখছেন তার বাবা।
এই প্রেরণা নিয়ে আবারও বাংলাদেশের নেতৃত্ব বাছাইয়ের লড়াইয়ে থাকা শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নিজের মুখে শুনিয়েছেন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তার জীবন এগিয়ে চলার কথা।
ঢাকার একটি মিলনায়তনে ওই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পেশাজীবী, উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীসহ দেড়শ তরুণ-তরুণীর মুখোমুখি হয়ে তাদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় নিজের জীবনের নানা অজানা কথা প্রকাশ্যে আনেন তিনি। ভবিষ্যৎ দেশ পরিচালনা নিয়ে তরুণদের ভাবনাও শোনেন।
ডা. নুজহাত চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয় রাজনীতিতে না এলে কী করতেন? ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন তিনি?
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার ছোট বেলায় ইচ্ছা ছিলো ডাক্তার হব। এসএসসি পরীক্ষা দিলাম, তখন দেখলাম অঙ্কে কাঁচা। আর বন্ধুরা সবাই আর্টসে ছিল, আমিও আর্টসে ভর্তি হই। এরপর ইচ্ছা ছিলো শিক্ষক হবার। আবার শিক্ষক মানে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বাচ্চাদের পড়াব।”
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রধান এবং সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা কেন ছোটবেলার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেন না তাও উঠে এসেছে নানা ঘটনার বর্ণনায়।
উপস্থাপিকা জানতে চান তরুণ শেখ হাসিনা সমন্ধে।
স্মৃতি হাতড়ে প্রধানমন্ত্রী বলতে থাকেন, “প্রথমে ঢাকায় আসলাম ’৫২ সালে। তখন বাবা কারাগারে কিন্তু উনার সাথে দেখা হল না। হাঙ্গার স্ট্রাইক করার কারণে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ফরিদপুরে। আবার আমরা ফিরে গেলাম। এরপরে নির্বাচন হল ১৯৫৪ সালে। আব্বা তখন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তিনি আমাদের নিয়ে এলেন ঢাকায় ’৫৪ সালে। আমরা, আমি, কামাল আর জামাল তখন ছোট মাত্র হামাগুঁড়ি দেয়, একেবারেই ছোট, কোলে। তখনো আমার বাবা খুব ব্যস্ত। উনি সেই সকালে বেরিয়ে যান আর গভীর রাতে যখন ফেরেন আমরা ঘুমিয়ে থাকি।”
অভাবটা (বাবার) বোধ করতেন, তাই না- উপস্থাপিকা জানতে চান।
সে সময় ১৪ দিনের নোটিশে মিন্টো রোডের বাড়ি থেকে তাদের বের করে দেয় হয়েছিল শেখ হাসিনা বলেন, “কোথায় মিন্টো রোড, সেখান থেকে গেলাম নাজিরাবাজার, আলাউদ্দিন রোড। পুরনো ঢাকায় যেখানে গাড়িটাড়ি ভেতরে যায় না। রিকশাই চলে। আমাদের গাড়িটাড়ি কিছুই নাই। আমরা রিকশায় চড়ি। এই যে আমাদের জীবনটা, সব সময় উত্থান পতনের মধ্য দিয়েই চলত। তাতে একটা জিনিস, আমরা কখনো অভাব বোধ করতাম না। আমার বাবা বোধহয় ছোট বেলা থেকে আমাদের এমনভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন, জীবনটা যখন যেভাবে আসবে সেভাবে মেনে নিতে হবে। আমরা কিন্তু সেভাবেই মেনে নিতাম এবং সেভাবেই করতাম।”
এক তরুণ প্রশ্ন করেন, মুক্তিযুদ্ধকালে আপনার পরিবার অবরুদ্ধ ছিল, সেই সময়টার বিষয়ে জানতে চাই। কীভাবে কেটেছিল?
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি যেহেতু সব সময় রাজনীতিতে ছিলাম, আমরা ভাই-বোন সবাই রাজনীতিতে ছিলাম। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য আমার বাবার যে পরিকল্পনা ছিল, এটাও আমরা নিজেরা অনেকটাই জানতাম। বাইরে হয়ত ততটা প্রচার ছিল না। কিন্তু তিনি আমাদের বলতেন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত কী হবে না হবে সব কিন্তু তিনি ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিলেন। যখন স্বাধীনতার ঘোষণাটা আসল, ৭ই মার্চের পর থেকে দেখলাম সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
“১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হওয়ার সাথে সাথে উনার যে মেসেজটা ছিল, সেটা বিজিবি তৎকালীন ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিল। সেই সাথে সাথে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা বাড়িতে ঢোকার ঠিক কিছুক্ষণ আগে জাকির খান নামে এক ভদ্রলোক আমাদের পরিচিত তিনি এসেছিলেন। তিনি আমাকে, আমার ছোট বোন রেহানাকে এবং আমাদের এক খালাত বোনকে বললেন, আপনারা এখনই এই বাসা থেকে চলে যাবেন। এদের বিশ্বাস করবেন না। এরা কী করতে পারে আপনারা জানেন না।
“এক রকম জোর করেই আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এরপর আব্বাকে অ্যারেস্ট করার পর কারফিউ জারি হল। আর আমার মা ছিলেন বাসায়, আমার ছোট ভাইটা রাসেল আর মেঝ ভাই জামাল। আমরা এসে মাকে খুঁজে পেলাম। ওই সময় আমরা বিভিন্ন জায়গায় থেকে শেল্টার নিয়েছিলাম। কিন্তু এক সময় আমরা গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম। আর যেহেতু তখন আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার প্রথম সন্তান হবে। কোথাও থাকা, শেল্টার পাওয়াও খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল।”
এরই এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান জানিয়ে তিনি বলেন, “যখন অ্যারেস্ট করা হল, পুরাতন ধানমন্ডি-১৮ নম্বর রোডের একতলা একটি বাড়িতে আমাদের নিয়ে রাখা হল। সেই বাড়িটায় কিছুই ছিল না। কোনো ফার্নিচার নাই, কিছুই নাই। সব ধুলোমাটিতে ভরা। পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের একটি কম্বল দেয়। পুরো পরিবারের জন্য ওই একখানা কম্বল ছিল, একমাত্র সম্বল। কোনো খাওয়া-দাওয়া কিছু নাই। কারণ দুপুর বেলা অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে, সারা দিন-সারা রাত ওই অবস্থায় থাকতে হল আমাদের।
শেখ হাসিনা বলেন, “তবে একটা জিনিস আমরা কখনো মনের জোর হারাইনি। আমাদের একটা ধারণাই ছিল, দেশ একদিন মুক্ত হবেই, স্বাধীন হবেই। আর জামাল ওই জেলখানায় থাকতে একদম প্রস্তুত ছিল না। সে বলত, আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবেই। ও খুব গেরিলা কায়দায় একদিন পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল।
“অত কষ্টের মধ্যে থেকেও দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় কথা। কিন্তু যেদিন পাকিস্তান আর্মি স্যারেন্ডার করল, ১৬ ডিসেম্বর, আমরা কিন্তু মুক্তি পাইনি। তখন মনে হত সত্যেন সেনের কথা, রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ, চারিদিকে শুনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। আমরা ভেতর থেকে স্লোগান দিতাম। আমি, মা, রেহানা সবাই কিন্তু ভেতর থেকে স্লোগান দিচ্ছি। আমরা কিন্তু তখনো বন্দী। ১৭ ডিসেম্বর আমরা মুক্তি পেলাম।
“দেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেল, মনে হল যেন সব কষ্ট ভুলে গেলাম।”
এ সময় এক তরুণ জানতে চান তরুণ শেখ হাসিনারর রাজনৈতিক জীবনের গল্প।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “রাজনৈতিক একটি পরিবারে জন্ম। আর রাজনীতি আমাদের সাথে এমনভাবে জড়ানো ছিল যে, রাজনীতিতে ঠিক কখন প্রবেশ করলাম তা সঠিকভাবে বলতে পারব না। স্কুল জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। সেই সময় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন, তারপর আরও বিভিন্ন আন্দোলন। যখন আন্দোলন হত তখন এটা ঠিক স্কুল পালিয়ে চলে যেতাম সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মিটিং শোনার জন্য। আবার স্কুল থেকে আমাদের সংগঠন করতে হবে, ছাত্রলীগ করতে হবে বলা হল।
“ছোটবেলার একটা মজার ঘটনা বলি, ধর্মঘট চলছে তখন। আমাদের হেডমাস্টার আবার ভীষণ কড়া ছিলেন। কাজী ওমর আলী সাহেব। আমি উনাকে দেখলে ভয়ে দৌড়ে পালাতাম। কিন্তু খুব আদরও করতেন, খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। মানে গাধা পিটিয়ে মানুষ করা বলে না, উনিও তেমন আমাদের গাধা পিটিয়ে মানুষ করতেন। আমরা ঠিক করলাম, স্কুল ছুটি দিতে হবে। তা এমনিতে তো আর দেবে না। হেড স্যারের রুমের পাশেই স্কুলের ঘণ্টিটা। এখন ঘণ্টিটা আমরা কীভাবে বাজাব? আমরা একটা মেয়েকে দায়িত্ব দিলাম ঘণ্টিটা বাজাবে। আরো কয়েকজনকে দায়িত্ব দিলাম দারোয়ান কিছু বোঝার আগেই গেটটা খুলে দেবে।
ঢাকার আজিমপুর গার্লস স্কুলে পড়তেন শেখ হাসিনা। স্কুলজীবনেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “একদিন স্কুলে স্ট্রাইক করাতে গিয়ে দেখি খুব লম্বা চওড়া এক পুলিশ অফিসার, সে আমাকে ধমক দিচ্ছে। আমরা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। তো খুব ধমক দিচ্ছে যে, তুমি জানো আমি কে? তোমাকে আমি জেলে নিতে পারি। আমি বললাম, জেলখানায় তো আমরা প্রতি ১৫ দিন পরপর যাই। আমাকে এই ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। সে বলল, হ্যাঁ! তোমার নাম কী? আমি বললাম, আমার নাম, আর বাবার নাম হেড স্যার জানেন। তাকে জিজ্ঞাসা করে নিয়েন।
“তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের বেড়া ফাঁক করে ওখান দিয়ে ঢুকে যেতাম। বাস ছিল মুড়ির টিনের মতো। তা সে রকম একটা গাড়িতে পুলিশ আমাদের ধাওয়া করছে। ওখান থেকে বের হয়ে পলাশী মোড় হয়ে এখন যেটা জহরুল হক হলের ভিতর দিয়ে ওয়াল টপকে ওখান থেকে গিয়ে আমরা রোকেয়া হলে ঢুকে গেলাম।”
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকার গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) ভর্তি হন শেখ হাসিনা। ষাটের দশকের পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ তাকে নিয়ে যায় ছাত্র রাজনীতির আরও গভীরে।
শেখ হাসিনা বলেন, “যখন কলেজে ভর্তি হলাম। আমি ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে সেখানকার ছাত্রীরা খুবই উৎসাহিত। আবার আমাদের ছাত্রলীগের নেতারাও খুব উৎসাহিত। আমাকে প্রথমে ছাত্রলীগের সেক্রেটারি করা হল কলেজ ইউনিটের। আমরা বিভিন্ন কলেজে গিয়ে গিয়ে সংগঠন করতাম। তখন প্রত্যেক কলেজে বার্ষিক নির্বাচন হত। তখন আমাকে সংগঠনের সেন্ট্রাল কমিটি থেকে জানানো হল, তোমাকে নির্বাচন করতে হবে।
“আবার আমার মা খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। মা বলেন, যদি তুমি ইলেকশনে জিততে না পার তাহলে মানুষ মনে করবে ছয় দফার প্রতি সমর্থন নাই। আর সরকারের কথা ছিল, যদি আমি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে, সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থীদের ছয় দফার প্রতি সমর্থন রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটা বাধা। বাসায় আসলে মা বলত, এখনই যাও, উইথড্র কর। কলেজে গেলে আমার বান্ধবী যারা ছিল বা সংগঠন থেকে বলত, না, উইথড্র করা যাবে না। তুমি ত জিতবে, তুমি কেন প্রার্থী থাকবে না?' এই এক টানাপড়েনের মধ্যে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমার মা খুব শক্ত ছিলেন। মা বললেন, সব কিছু বন্ধ। টাকা পয়সা সব বন্ধ। কিছু দেব না। তুমি ইলেকশন করতে পারবে না। যা-ই হোক এরপর একটা পর্যায়ে ইলেকশন হল। ইলেকশনে আমি জিতলামই না শুধু, আমার বিপক্ষে দুই প্রার্থী ছিল। তাদের দুইজনের ভোট যোগ করেও তার দ্বিগুণ ভোট আমি পেলাম।
“তখনকার ছবিও আছে। কাগজের মালাটালা দিয়ে আমাকে নিয়ে গেল শহীদ মিনারে। বক্তৃতা দিতে হবে। তখন মুখে রংটং মাখা ওই অবস্থায়। শহীদ মিনারে যখন আমাকে দাড় করিয়ে দিল বক্তৃতা দিতে, তখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেখানে। কলেজে আমগাছের একটা বেদি ছিল। কোনো কিছু হলে সেটার ওপর দাঁড়িয়ে খুব বক্তৃতা দিতাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে সত্যিই আমি আর বক্তৃতা দিতে পারলাম না। খুব ইমোশনাল হয়ে গেলাম। চোখে শুধু পানি আসছিল। জীবনে প্রথম শহীদ মিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে আমি সত্যিই নার্ভাস হয়ে গেলাম।”
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিতে ফিরে শেখ হাসিনা বলেন, “যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন শুনলাম, গভর্নর ডেকে ভিসিকে বলছেন, গণি সাহেব ভিসি ছিলেন। তাকে বলছেন, শেখ মুজিবের মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো কীভাবে? তিনি বলেন, হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে প্রতি বছর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। আলাদাভাবে খোঁজ নেওয়ার সুযোগ কোথায়? তিনি বেশ একটু ডাটের লোকই ছিলেন।
“আব্বা যখন মন্ত্রী ছিল তখন শিক্ষকরা খুব আদর করতেন। আবার আব্বা যখন জেলে গেল তখন বলত, ও, ওর বাবা ত জেলে। তখন যত দোষ আমাদের ওপর। মানে, যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর। এমন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমার বাবা কাজ করছে এটা জানতাম বলে এই চড়াই-উতরাইটাকে আমরা বেশ সহজভাবে নিতে পেরেছিলাম। এটা আমার মায়ের শিক্ষা, আমার দাদা-দাদির শিক্ষা।”
মায়ের কঠোরতার স্মৃতিতেও ফিরে যান শেখ হাসিনা: “হয়ত মিটিংয়ে যাব। মা হঠাৎ করে বললেন, মিটিংয়ে যেতে পারবে না। আর মা যদি একটা কথা বলতেন তা অমান্য করে কিছু করা আমাদের সাধ্যে ছিল না। মা দরজাও লাগাতেন না, গেটও লাগাতেন না। কিছু করতেন না। শুধু বলতেন, যেতে পারেব না। আর আমাদের সেই শিক্ষা ছিল, মা বললে শুনতে হবে। কিন্তু প্রতিবাদও ত করতে হবে। সুতরাং হাঙ্গার স্ট্রাইক। নাস্তা খাব না, ভাত খাব না, কিচ্ছু খাব না। বসে বসে ভ্যা ভ্যা করে কান্না।
“কিন্তু আমার দাদা থাকলে খুব ভালো হত। দাদা শুধু ডেকে মাকে বললেন, দেখ, আমি তো কোনো দিন আমার ছেলেকে মানা করিনি। কোনো দিন নিষেধ করিনি। তুমি নিষেধ করছ কেন? ও যেতে চায়, যেতে দাও। আমার মা আবার মুরুব্বিদের কথা খুব মেনে চলতেন। দাদা বলেছেন। মা আর কিছু বললেন না। যাও, দাদাকে পেয়েছ এখন যাও।”
শেখ হাসিনা বলেন, “এটা এতটা অপ্রত্যাশিত ছিলো…! আর সেই সাথে একটা ভয়ও হত। একটা ছবি আছে না, আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে, ওটা আব্বার সাথে আমার শেষ ছবি। আমরা তখন ইউরোপ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। তখন বেলজিয়ামে। হঠাৎ একদিন সকালে ফোন। বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর বললেন, ওখানে খুন হয়েছে। ওই কথা শোনার পর মনে হল, তাহলে তো আমাদের আর কিছু নাই। ওদের ভাষায়, টিভিতে আব্বার শুধু ছবি দেখছি। কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
“জার্মানিতে ফিরে এলাম। তখন সেখানে অ্যাম্বাসেডর যিনি ছিলেন তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। উনি, উনার ওয়াইফ, সবাই খুব সান্ত্বনা দিলেন। তিনি এক সময় আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, তিনি বিভিন্নভাবে খবর নিয়েছেন, সম্ভবত কেউ আর বেঁচে নাই। আমি আসলে বলতে পারব না। জীবনের ওই সময়টা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। আমি এসে দেখলাম, রেহানা শুয়ে আছে। আমি আস্তে করে রেহানাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলাম।”
শেখ হাসিনা বলেন, “তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। মার্শাল টিটোও ফোন করেছিলেন। তারপর আমরা ভাবলাম, না আমরা ফিরে যাই দেশে। দেখি দেশে যেতে পারি কি না। তারপর চলে এলাম দিল্লিতে। তখন জানতে পারলাম, কেউই বেঁচে নেই। এর আগেও মনে আশা ছিল, মা, রাসেল হয়ত বেঁচে আছে। কিন্তু মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা হলে তিনি জানালেন, না কেউই বেঁচে নেই। প্রথম কয়েকটা বছর আসলে বিশ্বাস করতে পারিনি। বিশ্বাস করতে চাইনি। নামাজ পড়তাম, মোনাজাত ধরতাম। কিন্তু বাবা-মার কথাটা কখনোই বলতে পারতাম না। ভেতর থেকে আসত না। যা-ই হোক, দিন চলে যায়।”
একজন প্রশ্ন করেন, ১৯৮১ সালে যখন আপনি দেশে ফিরে এলেন তখন কারা বা কোন বিষয়টা আপনাকে মোটিভেট করেছিল? এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে, মানে আপনি সাহস কোথা থেকে পেলেন? আপনার ভয় করেনি?
শেখ হাসিনা বলেন, “পঁচাত্তর পরবর্তী তিন-চার বছর একটা অন্ধকার সময় ছিল। বলা যায় একটা বাসায় বন্দী। সব জায়গায় যাবার সুযোগ ছিল না। এমনকি নিজের পরিচয় দেবারও সুযোগ ছিল না। একটা নামও দেয়া ছিল। ওই নামে আমাদের পরিচয়। তখন মনে হত, জীবনের সব থেকে কম যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু নিয়েই চলব। সেখানে থেকে সংসারের প্রতিটি কাজ একে একে আমাদের শিখতে হল, করতে হল। করে করে শিখলাম। বাড়ির বড় মেয়ে ছিলাম। আলসেও ছিলাম খুব। এমনও অনেক দিন গেছে, না খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। আব্বা এসে ঘুম ভাঙিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিতেন। আমার খুব বদ অভ্যাস ছিল, বসে গল্পের বই পড়া আর গান শোনার। তখন মা এক কাপ চা বানিয়ে এনে দিতেন। নিজে খুব একটা বেশি কাজ করতাম না, আলসে ছিলাম এটা ঠিক। আর সেখান থেকে এমন একটা অবস্থায় পড়ে গেলাম যে, ঘর ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে সব কিছু নিজেদের করতে হত।
“ছোট বেলা থেকে আব্বার সাথে সাথে থেকে জানা, উনি বাংলাদেশের জন্য কী করবেন, বাংলাদেশটাকে কীভাবে গড়ে তুলবেন; সব সময় এ গল্পটা করতেন। করতেন বলেই মনে হল, এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। আমাদেরতো কিছু করতে হবে, দেশের জন্য। আর কিছু না হোক, মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আসব (দেশে)। এটা ঠিক, ওই সময় আসাটা বেশ ভয়াবহ ছিল। তার কারণ, খুনিদের কিন্তু বিচার হয়নি। এতগুলো খুন যারা করল, একটা ছোট্ট শিশুকেও তারা ছাড়েনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “যখন এয়ারপোর্টে নামলাম, ওই সময়টা ছিল খুব কষ্টের। কারণ আমি যখন যাই তখন আমাদের সবাই ছিল। আর আমি যখন ফিরে এলাম তখন হাজার হাজার মানুষ। আর মুষলধারে বৃষ্টি। আকাশে ঘন মেঘ। আমার মন তখন হাহাকার করছে। কারণ যে মুখগুলো আমি দেখতে চাচ্ছি সে মুখগুলো তো দেখতে পাচ্ছি না। তাদেরকে খুঁজে পাচ্ছি না।
“এই বাংলাদেশ আমার বাবা স্বাধীন করে গেছেন। এই বাংলাদেশের মানুষগুলো দরিদ্র, দুঃখী। তাদের জন্য আমার কিছু করতেই হবে। তবে এত বড় দলের দায়িত্ব নিতে হবে, সেটা ভেবে আমি আসিনি। কাজ করব একজন কর্মী হিসেবে, এটা ভেবেই দেশে এসেছিলাম। এখনো আমি আওয়ামী লীগের একজন সার্বক্ষণিক কর্মী। আর প্রধানমন্ত্রী হবার পর মনে করি, আমি বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মী। আর যখন ভালো কিছু করতে পারি দেশের জন্য, তখন মনে হয় আব্বা দেখছেন। ভয় পাইনি কখনো, আর ভয় পাবও না, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত।”
সেই সময় স্রোতের বিপরীতে তার যাত্রা সম্পর্কে জানতে চান উপস্থাপক।
শেখ হাসিনা বলেন, “বনানী কবরস্থানে আমি যখন গেলাম, সেখানে সারি সারি কবর। কিন্তু ৩২ নম্বরের বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি কখনো। এমনকি আমি যে একটু মিলাদ পড়াব বা বাবা-মার জন্য দোয়া করাব সেই সুযোগও তৎকালীন সরকার আমাকে দেয়নি। তখন ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। বললেন, আমার থাকার জন্য অনেক বড় বাড়ি দেবেন। আমি বললাম, অনেক বড় বাড়ির দরকার নেই। এই বাড়িতে আমার বাবা-মা শাহাদাৎবরণ করেছেন, আমি এখানে যেতে চাই তাদের জন্য জন্য মিলাদ পড়ব, দোয়া করব। আমাকে কিন্তু ঢুকতে দেয়নি।
“আর একটি মাত্র টিভি, একটি মাত্র রেডিও। মিথ্যা ও অপপ্রচার ছিল। সরকারের তরফ থেকে বাধা ছিল। দলের ভেতর থেকেও ছিল বাধা। কিন্তু তা অতিক্রম করতে পেরেছি।”
এক তরুণ প্রশ্ন করেন, ২০০৭ সালে আপনি আপনার ছেলেকে দেখতে বিদেশে গেলে দেশে আসার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়। বলা হয় দেশে আসলে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে। আপনি কি তারপরও ভয় পাননি?
শেখ হাসিনা বলেন, “রাজনীতি করতে দেখেছি, করে এসেছি। জানি আমাকে জেলে যেতে হবে। তাই এটা নিয়ে আমার কখনো দুশ্চিন্তা ছিল না।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আমার জীবনটাকে উৎসর্গ করেছি দেশের মানুষের জন্য। আসলে আমার নিজের বলতে কিছু নেই। রাতে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমাই। আর বাকি সময় চেষ্টা করি, কত দ্রুত আমার কাজগুলো শেষ করতে পারি। কারণ আমি জানি, যে কোনো মুহূর্তে চলে যেতে হতে পারে। কখনও গুলি, কখনও গ্রেনেড হামালায়। তাই প্রতিটি মুহূর্তে দেশের মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়ার চেষ্টা করি।”
এক দর্শক প্রশ্ন করেন, নিজের শরীর কীভাবে ঠিক রাখছেন?
শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের জীবনে রুটিন ঠিক থাকে না। তবে ফিট থাকতে আমি নামাজ পড়ি নিয়মিত। আর তেমন ব্যায়াম হয় না। আর গণভবনে থাকা বন্দী জীবনের মতো। তারপরও চেষ্টা করি সকালে উঠে একটু হাঁটতে। ছাদে হাঁটি। আর পরিমিতভাবে খেলে সুস্থ থাকা যায়। আর চিন্তা ভাবনাকে স্বচ্ছ রাখা এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, আমি সুস্থ্ থাকব এটা ভাবা।”
আরেক তরুণের প্রশ্ন, নানি বা দাদি হিসেবে আপনি কেমন? নাতি-নাতনিদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেটা আমার নাতিদের জিজ্ঞাসা করলে বলবে। আমরা লুডু খেলি, ক্যারাম খেলি, দাবা খেলি। তারা আমার হাতের রান্না পছন্দ করে। আর ছোট একটা আছে সে আবার খুব ডিমান্ড করে। বলে দেয়, তুমিই রান্না করবে। ববির ছোটটা। সে বলে, তুমিই রান্না করবে। সে কোলে চড়ে বসে আবার নির্দেশও দেয়। এটা দাও, ওটা দাও। বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনি নিয়ে থাকার থেকে আর কোনো সুখের সময় হয় না।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ চারটি সংবাদমাধ্যম অনুষ্ঠানটির সংবাদ সংগ্রহ করে। সিআরআইর ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও নসরুল হামিদ বিপু এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।