বামজোটের ইশতেহারে রাজনীতিতে ‘গুণগত পরিবর্তনের’ প্রতিশ্রুতি

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়’ প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং দেশের রাজনীতিতে ‘গুণগত পরিবর্তন’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2018, 03:17 PM
Updated : 12 Dec 2018, 03:17 PM

বুধবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ৩২ দফা প্রতিশ্রুতি সম্বলিত এই ইশতেহার ঘোষণা করা হয়।

বাম জোটের সমন্বয়কারী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,“আমাদের লক্ষ্য দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের গুণগত পরিবর্তন করা। এই লক্ষ্যে আমরা জনগণের কাছে যাব, তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করব।”

তিনি বলেন, বাম জোট থেকে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সংসদে এসব দাবির পক্ষে লড়াই করবেন। সংসদের বাইরেও ‘লড়াই’ অব্যাহত থাকবে।

আট বাম দলের এই জোটে নিবন্ধিত দল আছে তিনটি। এর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কাস্তে, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মই এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কোদাল প্রতীক নিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচন করছেন মোট ১৩১ জন।

বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ জানান, বাম জোটের প্রার্থীদের মধ্যে ৭৪ জন কাস্তে প্রতীকে, ৪৩ জন মই প্রতীকে এবং বাকি ২৮ জন কোদাল প্রতীকে ভোট করছেন এবার।

 

যা আছে ইশতেহারে

# ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংবিধান, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাজনীতির সংস্কার করবে বাম জোট। ‘কার্যকর’ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার নিশ্চিত করবে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতায়ন’ করা হবে।

# কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমঘণ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করাসহ বিকল্প অর্থনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করার পরিকল্পনার কথা রয়েছে বাম জোটের ইশতেহারে।

# দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দরিদ্রদের জন্য স্থায়ী রেশনের ব্যবস্থা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য সরকারি বাফার স্টক ও টেস্ট রিলিফ চালু এবং দেশব্যাপী দক্ষ ও শক্তিশালী গণবণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় বাম জোট। পাশাপাশি ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, দুবৃত্তায়ন-মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে তাদের।

# সকল খাসজমি উদ্ধার করে সমবায়ের ভিত্তিতে কৃষককে দিতে চায় বাম জোট। দরিদ্র গ্রামীণ কৃষক-খেতমজুরদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চত করার ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আবাদি জমি সংরক্ষণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বন্ধ কলকারখানা চালু করা হবে। স্বাস্থ্যখাত ও চিকিৎসার মান উন্নয়নে সুষম ও অভিন্ন গণমুখী চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও ওষুধ নীতি চালুসহ পর্যায়ক্রমে সবাইকে সরকারি স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নিয়ে আসবে বাম জোট, যদি তারা সরকারে যায়।

# বিশ্ব ব্যাংকের ‘কৌশলপত্র’ বাতিল করে সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন এক ধারার গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় বাম জোট। নারীর প্রতি বৈষম্য রোধে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালু এবং জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়ন করবে তারা। প্রতিবন্ধীদের জন্য ২০০৬ সালে গৃহীত প্রতিবন্ধী জনগণের অধিকার বিষয়ক সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করবে।

# বাম জোট ক্ষমতায় গেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে। বিভিন্ন জাতিসত্তা, আদিবাসী সমাজ ও দলিতদের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর সহ আনুষাঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য গঠিত ভূমি কমিশন কার্যকর এবং সমতল ভূমির সাঁওতাল, হাজং, গারো, ওঁরাও সহ সকল জাতিস্বত্তার জন্য ভূমি কমিশন গঠন করা হবে।

# দরিদ্র নিম্নবিত্তদের জন্য গৃহনির্মাণ ঋণ প্রকল্প চালু এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষায় বাড়িভাড়া আইন কার্যকর করা হবে।

# প্রকৃতি,পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সুন্দরবন এলাকায় শিল্প-কারখানা নির্মাণ বন্ধ করা এবং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা করবে বাম জোট। দেশের সব নদী ও জলাধারের পাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাবহার কমিয়ে ভূ উপরিভাগের পানি ব্যাবহারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে তারা।

# জ্বালানি খাতের দুর্নীতি বন্ধে দায়মুক্তি আইন বাতিল করারও প্রতিশ্রতি রয়েছে বাম জোটের ইশতেহারে।

# বাম জোট বলছে, ক্ষমতায় গেলে সশস্ত্র বাহিনীকে পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের সক্ষম তরুণ-তরুণীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘গণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ গড়ে তুলবে তারা। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর যাবতীয় কার্যক্রম জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করবে।

# স্বাধীন ও সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে বাম জোটের ইশতেহারে।  তারা ক্ষমতায় গেলে সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, নব্য নাৎসীবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া হবে। এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জাতি ও আন্দোলনগুলোর সঙ্গে ঐক্য ও সংহতি জোরদার করা হবে।

বাম জোটের শীর্ষ নেতা সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সংবাদ সম্মেলনে বলেন,“এই ইশতেহারে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের স্বার্থের প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা আশা করছি, দেশের জনগণ বামজোটের ইশতেহার বাস্তবায়নে আমাদের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করবে।”

অন্যদের মধ্যে বিপ্লবী ঐক্য ফ্রন্টের সভাপতি মোশরেফা মিশু, গণসংহতি আন্দোলন কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের নেতা নজরুল ইসলামসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।