মাশরাফির ভোট ভাবনা ‘সিরিজ শেষের আগে না’

ভোটের লড়াই উৎরাতে আগামী সপ্তাহেই দ্বারে দ্বারে ঘোরা শুরু করবেন জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীরা, তবে বাংলাদেশ ওয়ান ডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হওয়ায় সেই ভাবনা এখন একেবারেই ‘ভাবতে চাচ্ছেন না’ মাশরাফি বিন মর্তুজা।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2018, 11:33 AM
Updated : 4 Dec 2018, 01:50 PM

নিজের এলাকা নড়াইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়া মাশরাফি বলছেন, এখন শুধুই ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে চান তিনি । সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে সিরিজ শেষ হওয়ার পরেই কেবল নির্বাচনে মনোযোগ দেওয়ার ইচ্ছা তার।

আগামী রোববার ঢাকায় শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিন ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজ, যা শেষ হবে ১৪ ডিসেম্বর।

এর মধ্যে রোববারই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় সীমা পেরিয়ে পরদিন থেকে ভোটের প্রচারে নামবেন প্রার্থীরা।

এখন আসন্ন সিরিজ নিয়ে অনুশীলন ও দলীয় ভাবনায় ‘নিমগ্ন’ মাশরাফি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন খেলা, রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে তার পরিকল্পনা।

এখন এ বিষয়ে কথা বলার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন মাশরাফি: “খেলার আগে এই নিয়ে আপনাদের থেকে আর কোনো প্রশ্ন না হোক, এইজন্য যেটা করার এখনই করে ফেলা আর কি।”

“না হলে ম্যাচের আগের দিন যদি প্রেস কনফারেন্স করতাম এই প্রশ্নগুলো তখন হত। আমি ব্যক্তিগভাবে মনে করেছি, আপনাদের মনে যদি প্রশ্ন থাকে তাহলে এখনি ফেইস করা উচিত।”

এখন নির্বাচন নয়, খেলা নিয়েই ভাবছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন আমার কাছে একদমই না। আমার মাইন্ড সেট আপে একদমই না। আমার পুরোপুরি অনুশীলনে মন আছে। অবশ্যই ১৪ তারিখের পর আমি ওই খানে মনোযোগ দেব। ওইখানে যা করার ১৪ তারিখের পর... এর আগে পুরোপুরি কনসেনট্রেশন খেলায় রাখব।” 

মাশরাফি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে তার এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। সমালোচনা এসেছে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজনের কাছ থেকে।   

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাশরাফি বলেন, “আমি সব সময় বিশ্বাস করি যে, আপনার নিজের পারসোনালিটি থাকা উচিত। আপনি যদি কোনো দলকে সাপোর্ট করেন তাহলে অবশ্যই সেটা প্রকাশ্যে বলা উচিত। এমন অনেকেই আছে যারা সাপোর্ট করে, কিন্তু বলতে পারে না।

“প্রত্যেকে যে যার দল করে তার সম্মানটা থাকা উচিত এবং তার মতো করে দেশের জন্য কাজ করবে-এই মানসিকতাই থাকা উচিত। যারা কমেন্ট করছে বা করবে তা আমার নিয়ন্ত্রণে নাই।” 

ক্রিকেটের বাইরে রাজনৈতিক লোকজনের সঙ্গে উঠাবসা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না, এখনও ঘুরার সুযোগ পাইনি। যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সিরিজটা খেলার পর যাব। নড়াইলের মানুষজনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আমি যেতে পারিনি, গেলে আমার যে কাজগুলো আছে, সেগুলো আমি করব।”

নিজের নির্বাচনী এলাকা নড়াইল-২ আসনের ভোটারদের সমর্থন নিয়ে সন্তুষ্ট মাশরাফি বলেন, “সাপোর্ট আলহামুদুলিল্লা ভালো আছে। আমি পারসোনালি এখনও যেতে পারিনি, তাই টোটালি বলাটা কঠিন। খেলার পরে গেলে বুঝতে পারব।” 

তার রাজনীতিতে নামার ঘোষণা পরিবারের কাছেও নতুন বলে জানান মাশরাফি বিন মর্তুজা।

তিনি বলেন, “পারিবারিকভাবে জানার পর এটা একটা নতুন জিনিস তাদের জন্য। তাদের জন্যও মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে, আমারও লাগবে। এটাই স্বাভাবিক।”

ক্রিকেট বোর্ড ও খেলোয়াড়দের কারও সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি-নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি বলেও জানান তিনি।

মাশরাফিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তরুণদের কী স্বপ্ন দেখাতেন চান তিনি। অনেক তরুণ এসে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে, অনেক বড় বড় কথা বলেন। গতানুগতিক রাজনীতিতে গা না ভাসানোর বিষয়ে কতটা আত্মবিশ্বাসী তিনি।

জবাবে তিনি বলেন, “সেই সুযোগটা যদি আমার আসে, এখনি চিন্তা করার সুযোগ নাই যে, আমি নির্বাচিত হয়ে গেছি। নির্বাচিত হওয়ার পর যদি আপনাদের মনে হয় রিভিউ করতে আমার কাজ, তখন করবেন। এখন আসলে বলা কঠিন।”

কোটাবিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় এগুলো নিয়ে কথা না বলার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল জনপ্রিয় এই ক্রিকেটারকে।

তিনি বলেন, “না, আমি তখন কোটা আন্দোলন নিয়ে যেটা হয়েছে, এত গভীর রাজনীতি আমি করিনি, জানিও না। যেটা পরিষ্কারভাবে বললাম, আমার উদ্দেশ্য খুব সিম্পল, যেটা মানুষের জন্য করে শান্তি পাই। টাচ পাই। ততটুকু।

“আমাকে যদি ডিপ লেভেলের পলিটিশিয়ান ভাবেন সেটা আমি এখনও হয়তবা না, হইনি। সো আমাকে ওই পর্যায়ে ভাবলে আমার প্রতি অবিচার হবে। আমার অভিজ্ঞতাটা একদমই নতুন। তবে আমি যেটা বলেছি, ভালো কাজ করতে চাই। সেটা হয়ত সামনে দেখা যাবে কতটুকু করতে পারি।”

এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচনের মাঠে নামার কারণ ব্যাখ্যায় মাশরাফি বলেন, “আমার ক্যারিয়ার অবশ্যই শেষের দিকে। না আমি শচিন টেন্ডুলকার না, আমি ম্যাকগ্রা না যে আমার কথা মানুষ স্মরণ রাখবে। আমি আমার মতো করেই ক্রিকেটটা খেলেছি। আমার স্ট্রাগলিং লাইফে যতটুকু পেরেছি খেলেছি। তবে আমি সব সময় এঞ্জয় করেছি মানুষের জন্য কাজ করতে পারা। এটা আমার ছোটবেলার শখ ছিল বলতে পারেন।

“যেই সুযোগটা আমি বললাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, বৃহৎ পরিসরে যদি কিছু করা যায়।”

বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে মাশরাফি বলেন, “প্রথমত ধরেন, আমি যদি ওয়ার্ল্ড কাপ পর্যন্ত ধরেন, আমি যেটা চিন্তা করেছি... আর সাত থেকে আট মাস বাকি আছে। বিশ্বকাপের পর আমার ক্যারিয়ার যদি শেষ হয়, নেক্সট সাড়ে চার বছরে কী হবে, আমি জানি না।

“আর আমার একটা সুযোগ আসছে, যেটা আমি উপভোগ করি সব সময়, মানুষের সেবা করার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা সুযোগ দিয়েছেন, আপনারা জানেন যে আমার একটা ফাউন্ডেশন আছে, আমার এলাকার জন্য কিছু কাজ করার। আমার মনে হয় এটা আমার জন্য গ্রেট অপারচুনিটি তাদের জন্য কাজ করার। স্রেফ এখান থেকেই মনে হয়েছে, হয়ত সাড়ে সাত-আট মাস পর তো আবার জাতীয় নির্বাচন হবে না।”

আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি দেশের মাশরাফি থেকে ‘দলের মাশরাফি’ হয়ে গেছেন বলে মন্তব্য এসেছে।

এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, “এটা খুবই স্বাভাবিক।  উদ্দেশ্য যেটা আমার পরিষ্কার- মানুষের জন্য কাজ করতে চাই, যদি সুযোগ পাই কাজ করব। আগেও বললাম আমি বিশ্ব ক্রিকেটে এমন কোনো সুপারস্টার না যে, আট মাস পরে আমি যখন খেলা ছেড়ে দিব তখন জনে জনে আমাকে স্মরণ করবে।”

মানুষের সেবা করা, তাদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার কাজ তো নড়াইল ফাউন্ডেশন দিয়েই হচ্ছিল, সেখানে রাজনীতিতে যোগ দিতে হল কেন, সে প্রশ্ন করা হয়েছিল মাশরাফিকে।

জবাব দিতে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি: “এবার আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করি, আমার ফাউন্ডেশনে কী কী কাজ হয়েছে বলতে পারবেন?”

“হ্যা রাস্তা তৈরি করেছেন...হাসপাতালের প্ল্যান করছেন...”

এরপর মাশরাফি বলেন, “একটাও কিন্তু ঠিক হয়নি। আমি রাস্তা কিন্তু করতে পারিনি। সব কিছু আপনাদের কাছে ক্লিয়ার না কিন্তু। আই ফাউন্ডেশন করে যেটা বুঝেছি, অনেক কিছুই কাজ করেছি। এটা সত্যি কথা। মানুষ জানে না, এমনকি নড়াইলের মানুষও জানে না। যেটা বললাম করার চেষ্টা করেছি। যে সুযোগটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন যে আরেকটু বড় পরিসরে করা সেটাই।”

সাংসদ হয়ে গেলে খেলা চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রথমত আমার লক্ষ্য বিশ্বকাপ পর্যন্তই থাকবে। বিশ্বকাপ পর্যন্ত আট মাসের ব্যাপার। আট মাস পর্যন্ত যেভাবে খেলে আসছি ওইভাবে খেলার চেষ্টা করব। আমার পারসোনাল গোলও ছিল বিশ্বকাপ। পরে সেটা রিভিউ করব কি না, সেই সময়ই বলে দেব।”

ক্রিকেট বোর্ডে আসতে চান কি না জানতে চাইলে মাশরাফি বলেন, “আমি তো আগেই বললাম, সামনে কী হবে জানি না। নির্বাচন হলে নির্বাচনে জিততে হবে। সো এই পর্যায় পার না হলে বলা যায় না কিছুই।”

টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেওয়ার কথা ভাবছেন কি না-প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “দেখা যাক, আমি তো দশটা কাজ তো একসাথে করব না। আর টেস্ট মনে হয় এমনিই বলে দেব। আর টেস্ট তো আট বছর ধরে খেলছি না।”

নির্বাচনে দল না জিতলে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হতে পারে, কালকে আপনার জীবনে কী ঘটবে আপনি জানেন না। আমার জীবনে কী ঘটবে, সেটাও আমি জানি না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ক্লিয়ার মাইন্ড নিয়ে যাচ্ছি কি না। আমি শুধু নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কালকে আমার সাথে কী হবে সেটা জানি না। তাই এতকিছু ভাবার সুযোগ এখন নাই।”

তবে এখন কেবল আসন্ন ওয়ান ডে সিরিজ জয় নিয়েই ভাবছেন বলে জানান অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।

অবশ্যই সিরিজটা জিততে চাই। আমার চোখে ঠিক আট দশটা সিরিজ যেভাবে খেলছি এটাও তাই।”