নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি বন্ধের দাবি নিয়ে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসে এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন কামাল, যিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখছেন।
তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হবে কি না।
“২০০৭ সালে আপনারা দেখেছেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী থেকে সবচেয়ে জোরালো বক্তব্যগুলো আসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। এটা কোনো বিতর্কিত বিষয় না। কোর্ট থেকে একটা রায় দিয়েছে যে, এটা সংবিধান সম্মত নয়। সেই রায়েও প্রথম লেখা ছিল, আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে।
“এখন বলছি যে, নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ হওয়া- এটা সংবিধানের একটা বিধান। এটা খেয়াল খুশির ব্যাপার না। ’৯৬ সালে সংবিধান সংশোধনীর কারণে বিশেষ করে ২০০৮ সালে পুরো উপকার মহাজোট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল নির্বাচনে যে ফলাফল পেল তাতে অবশ্যই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। এটা কোনো বিরোধের ব্যাপার নয়, এটা সংবিধানের ব্যাখ্যার ব্যাপার।”
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ হয়। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হয়।
দুটি নির্বাচন এভাবে হওয়ার পর ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
২০১১ সালের ১০ মে এক রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। পরের মাসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সরকার।
শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তা ঠেকানোর আন্দোলনে নামে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি জোটের ওই আন্দোলন এবং নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে তাদের তিন মাসের অবরোধে নাশকতায় অন্তত দুইশ মানুষের প্রাণহানি হয়।
এবার সেই অবস্থান থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ তুলছেন বিএনপি নেতারা। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির বদলে ‘সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’ পালন করছে বলেও অভিযোগ করছেন তারা।
‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “আমরা বিশ্বাস করি, জনগণ ক্ষমতার মালিক। যা কিছু হবে তাদের মতামত নিয়ে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে।”
কামাল হোসেন বলছেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করতে পারলে সংবিধানের মৌলিক নীতি অনুসরণ করা হবে।
তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশের রাজনীতি হচ্ছে হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি। কয়েক দশক ধরে এই হিংসা-প্রতিহিংসা চলে আসছে। যদি ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে তাহলে কি আপনারা ধারাবাহিক রাজনীতি অনুসরণ করবেন না কি নতুন কোনো রাজনীতি উপহার দেবেন।
জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের নতুন রাজনীতি না। সংবিধানে যেটা লেখা আছে, যে রাজনীতি আমরা তখন সংবিধানে যে নীতিগুলো লিখেছি। মৌলিক অধিকার সেখানে সংরক্ষিত হবে লেখা আছে, রাষ্ট্র হবে গণতন্ত্র, শাসন ব্যবস্থা হবে গণতান্ত্রিক। এগুলো আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামো, যার মধ্যে আমরা রাজনীতি করতে চাই।”
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন কামাল হোসেন।
সংবিধান সম্মতভাবে দেশ পরিচালনার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “জনগণ ক্ষমতার মালিক হিসেবে ভোটের অধিকার থাকবে তাদের। সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা নির্বাচিত করবেন তাদের প্রতিনিধি, সেটা সংসদ ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে। অর্থাৎ নতুন রাজনীতি আমাদের কিছু করা লাগবে না। সংবিধানে যেটা লেখা আছে সেটা যদি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি সংবিধানের নীতিটা পালন করে আমরা রাজনীতি করব।”
“নির্বাচনী ইশতেহার লেখা হচ্ছে, সেটাও কয়েকদিন মধ্যে আপনারা পাবেন। সেটাও সংবিধানের আলোকে করা হয়েছে।”
ড. কামাল হোসেন বলছেন, তার নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার সিদ্ধান্ত এখনকার নয়, এই সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন ২০০৮ সালে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার বয়স হলো ৮০। আমার সমবয়সী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে আর একজনই মাত্র বেঁচে আছেন। এই অবস্থায় আছেন যে, উনি না থাকার মতো। ওই মন্ত্রিসভার শেষ আমি এখনো বেঁচে আছি। এটা আল্লাহর রহমত, আমার কোনো কৃতিত্ব নাই।
“আমি রাজনীতি করে আসছি ৫৫ বছর ধরে। এখন এতোগুলো যোগ্য ব্যক্তিরা রাজনীতি করে বেরিয়ে এসেছেন আমি তো মনে করি যে, এটা ভুল ধারণা যে নেতৃত্বের কোনো ঘাটতি আছে। অতীতে দেখেছি যে, বয়স হয়ে গেলে সরে যেতে চান না। আমি ওই অর্থে সরে যাচ্ছি না, আমি কাজ-কর্ম থেকে সরে যাচ্ছি না। ২০০৮ সালে আমাকে বলা হয়েছিল, নির্বাচন করুন। আমার এই ‘না’ করাটা আজকের সিদ্ধান্ত না , ২০০৮ সালে আমি নির্বাচন করি নাই।”
প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া ভোট কেন্দ্রের বুথে প্রবেশ, ছবি তোলা ও ভিডিও করার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার সমালোচনা করেন কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “এটা নৈতিক একটা ব্যাপার। যদি আইনের শাসন থাকে যে ধরনের নিষেধাজ্ঞাগুলোর কথা বলা হচ্ছে, এটা অপ্রাসঙ্গিক। এটার ব্যাপারে আমরা দেখছি। কোর্টে যেতেও পারি।”
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী, হাবিবুর রহমান তালুকদার, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মনটু, নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মো. মনসুর আহমেদ, গণস্বাস্থ্য সংস্থার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির আবদুস সালাম, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এসএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়াসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।