মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে বুধবারই ঢাকার সেগুনবাগিচায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে (বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়) সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মনোনয়নপত্র দাখিল হয়।
দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোর অধিকাংশ প্রার্থী। তার মধ্যে সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশাবাদ জানিয়ে একমঞ্চে দাঁড়িয়ে নৌকা ও ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাওয়ার প্রস্তাব করেছেন বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সালাম ঢাকা-১৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হচ্ছেন। সেখানে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দী নৌকার প্রার্থী হচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের (উত্তর) সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর এ বিষয়ে আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমি উনাকে বলেছি, নির্বাচনী এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য প্রয়োজনে আমরা এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে যার যার দলের পক্ষে ভোট চাইব।”
তবে জবাবে সাদেক খান কী বলেছেন তা বলেননি আব্দুস সালাম, যিনি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হওয়ার আগে বিএনপির ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূল ‘পরিবেশ তৈরিতে’ নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপ চেয়ে এই বিএনপি নেতা বলেন, “এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। মোহাম্মদপুর, আদাবরসহ নির্বাচনী এলাকায় আমার আর কোনো কর্মীকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।”
নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে সালাম বলেন, “তিনি যেন মুক্তি পেয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইতে পারেন। আমরাও মানুষের কাছে বলব, আপনার একটি ভোটে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে।”
নির্বাচনে জয়ের আশাবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা সাদেক খান সাংবাদিকদের বলেন, “জনগণ নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, নৌকাকে জয়ী করতে জনগণ মাঠে নেমেছে। আশা করি, নৌকার বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।”
বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাসদ, জাকের পার্টিসহ অনেক নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত দল এবং ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতেও অনেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কে এম আলী আজম ঢাকা মহাগরীর ১৫টি আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
নির্বাচন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা মহানগরীর আসনগুলোর জন্য ২৩০টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হলেও ২১৩ জন তা দাখিল করেছেন।
কোনো কোনো প্রার্থী সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে, আবার কেউ কেউ প্রতিনিধির মাধ্যমে তাদের মনোনয়পত্র জমা দেন।
শেষ দিনে সকাল ১১টায় আওয়ামী লীগ মনোনীত ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ঢাকা-১০ আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়পত্র জমা দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হওয়ার মতো কোনো কাজ হবে না।”
ঢাকা ৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ সেলিম তার মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। একই আসনে আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী হতে মনোনয়পত্র জমা দিয়েছেন আবুল হাসনাত।
ঢাকা-১২ আসনে বিএনপির দুই প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। বিএনপি প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান নিজে উপস্থিত হয়ে এবং সাইফুল আলম নীরব প্রতিনিধির মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
ঢাকা ১৭ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের মনোনয়নপত্র জমা দেন দলের নেতা এসএম ফয়সাল চিশতী।
পরে চিশতী বলেন, “আশা করি, এরশাদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন। তিনি এখন সুস্থ আছেন, আগামীকাল হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরবেন।”
ঢাকার এই আসনটিতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৭ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, যাদের মধ্যে বিভিন্ন দলের ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীরা রয়েছেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (উত্তর) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের খান।
এছাড়া বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্সের (বিএনএ) সভাপতি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
গুলশান, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট ও ভাসানটেক এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে ধানের শীর্ষের প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রুহুল আলম চৌধুরী এবং পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল হাশেমের ছেলে শওকত আজীজ রাসেল।
এখানে নৌকার প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, “জনগণ আমাকে যেভাবে ভালোবাসে তা প্রকাশ করতে পারব না। অনেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। তাদের এই ভালোবাসা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় মরেই যাই। গত কয়েক দিনে মানুষের ভালোবাসা দেখে ও তাদের সাড়া পেয়ে পাগলই হয়ে গেছি।”
ঢাকা-১৫ আসনে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ।
তিনি বলেন, “নির্বাচনে এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। রাজনীতি করতে হলে গ্রেপ্তার হতে হয়, আমরা কোনো গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছি না।”
ঢাকা-৬ আসনে গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে। এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো তৈরি হয়নি, বরং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দিন সাহেব চেষ্টা করছেন। তার আচরণ-কথাবার্তায় মনে হয়েছে ইসি সচিব নির্বাচন চান না, পুরো নির্বাচন ধ্বংস করে দেবেন।
“নির্বাচন কমিশনের কারণে নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটা জাতির জন্য কলঙ্ক নিয়ে আসবে।”
এই আসনে বিএনপি প্রার্থী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার মনোনয়ন জমা শেষে বলেন, “সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে কেমন হবে নির্বাচন। তবে আমরা নির্বাচনের শেষ সময় পর্যন্ত মাঠে থাকব।”
বাম গণতান্ত্রিক জোট থেকে কোদাল প্রতীকের হয়ে ঢাকা-১২ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।
তিনি বলেন, “এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই নির্বাচনের। তবে আমরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।”
ঢাকা-৭ আসনে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু মনোনয়নপত্র জমা দেন।
তিনি বলেন, “ড. কামাল হোসেন ও তার মেয়ে সারা হোসেন নির্বাচন করবেন না। পুলিশ অনেকের তথ্য নিচ্ছে। মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রশাসনের হস্তক্ষেপ হবে।”
ঢাকা-১৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আসলামুল হক তার মনোনয়নপত্র জমা দেন। ঢাকা-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ঢাকা-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে আব্দুল বারেক মনোনয়পত্র জমা দিয়েছেন।
ঢাকা-১১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম রহমউল্লাহ মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এই আসনে জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ফয়সাল চিশতী।
ঢাকা-৬ এ জাতীয় পার্টির কাজী অ্যাডভোকেট ফিরোজ রশীদ, গণঐক্যের ববি হাজ্জাজ, জেপির সৈয়দ নাজমুল হুদা, জাসদের কাজী সালমা সুলতানা এবং বিএনপির ইশরাক হোসেন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ঢাকা-১০ এ গণফোরামের প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার ফরিদুল আকবর মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ঢাকা-১৮ আসনে গণফোরামের নির্বাহী সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর আমীন আহমেদ আফসারী এবং পিডিপি প্রার্থী মো. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা-১৫ আসনে মামুন হাসানের পক্ষে তার স্ত্রী ডলি হাসান মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপি প্রার্থী এসএ সিদ্দিক সাজু মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়। ঢাকা-৪ আসনে জাসদের (ইনু) হাবিবুর রহমান শওকত মনোনয়নপত্র জমা দেন।
সন্ধ্যায় রিটার্নিং কর্মকর্তা কে এম আলী আজম সাংবাদিকদের বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা করার তার সবই আমরা করছি। রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব আমার মূল দায়িত্ব এবং পবিত্র দায়িত্ব মনে করে পালন করছি।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশনের দেওয়া সকল বিধি আইন পালন করতে যা করার সবই করব। নির্বাচন সুষ্ঠু-অবাধ করতে সকল মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন। আমি মনে করি, সবাই সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে।”
মনোনয়নপত্র দাখিলে কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ আসেনি।”
রিটার্নিং কর্মকর্তা আলী আজম জানান, এবার অনলাইনের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র গ্রহণের পদ্ধতি চালু হয়েছে। ঢাকা-১৪ আসনে আজমিরা সুলতানা নামে একজন প্রার্থী তার মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
আজমিরা সুলতানা কোন দলের তা জানাতে পারেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা।