সাক্ষাৎকার গ্রহণে তারেক, নালিশ ইসিতে

নির্বাচনের আগে ফের আলোচনায় এল তারেক রহমানের নাম; যিনি বাংলাদেশের আদালতে দণ্ড নিয়ে লন্ডনে রয়েছেন।

মঈনুল হক চৌধুরীও কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2018, 04:47 PM
Updated : 18 Nov 2018, 04:51 PM

মা খালেদা জিয়া বন্দি থাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা তারেক রোববার একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেন।

ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির মনোনয়ন বোর্ডের এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ অনুষ্ঠানে লল্ডন থেকে স্কাইপে যুক্ত হন খালেদা জিয়ার ছেলে।

তারেকের তৎপরতার খবর প্রকাশের পর তাৎক্ষণিকভাবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে নালিশও জানিয়ে আসে।

অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের দলে মনোনয়ন বোর্ডে কে থাকবেন, সেটা কেবল তাদেরই বিষয়। বাইরের কারও তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। 

পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, এক্ষেত্রে আইনগতভাবে কিছু করার আছে কি না, তা খতিয়ে দেখবেন তারা।

এবিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেছেন, দণ্ডিত ও পলাতক আসামি হিসেবে তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর গ্রেপ্তার তারেক পরের বছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য সপরিবারে লন্ডনে যান। তারপর থেকে সেখানেই রয়েছেন তিনি।

লন্ডনে থাকা অবস্থায়ই দেশে বিএনপির কাউন্সিলে খালেদা জিয়ার পরের পদ জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন দলটির নেতা-কর্মীদের চোখে দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি তারেক।

যুক্তরাজ্য তারেক নানা সভা-সমাবেশে দেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে মৌলিক কিছু বিষয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার পর তার বার্তা-বিবৃতি প্রচারে কয়েক বছর আগে নিষেধাজ্ঞা আসে হাই কোর্টের তরফে।

এরপর মুদ্রা পাচারের একটি মামলায় তারেকের সাত বছর কারাদণ্ড হয়; পরে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় মায়ের সঙ্গে তারও সাজা হয় ১০ বছর কারাদণ্ড। সবশেষ গত মাসে একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়।

৫০ বছর বয়সী তারেকের দেশে ফেরার কথা বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলে এলেও নির্দিষ্ট কোনো সময় কখনও বলেননি। এর মধ্যে খবর বেরিয়েছে তার হাতে এখন বাংলাদেশি পাসপোর্টও নেই।

ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়া

বিদেশে থাকলেও গত ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়ে আসছেন বলে বিএনপি নেতারা জানান।

দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর কামাল হোসেনের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে বিএনপির ভোটে নামার পর রোববারই তারেকের দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ প্রকাশ্য হল।

৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী নির্বাচনে রোববার সকাল থেকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু হয়।

এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় বসেন; ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেন তারেক।

সাক্ষাৎকার দিয়ে বেরিয়ে আসার পর দিনাজপুরের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী সাংবাদিকদের বলেন, তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। তার কছে জানতে চেয়েছেন এলাকায় দলের সাংগঠনিক অবস্থা কেমন।

প্রতিক্রিয়া-পাল্টা প্রতিক্রিয়া

তারেকের খবর প্রকাশের পরপরই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “একজন দণ্ডিত, সাজাপ্রাপ্ত, পলাতক আসামি দলীয় ফোরামে এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারে কি না, সেটা আমি জাতির কাছে বলব। জাতির কাছে এর বিচার চাইছি।”

ইসিতে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল

সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করে জানান, দণ্ডিত তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ আইনের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান ইসিতে সাংবাদিকদের বলেন, “এটা নির্বাচনের এবং সর্বোচ্চ আদালতের আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছি। আমরা আশা করছি নির্বাচন কমিশন যথাযথ দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”

তিনি বলেন, “এটা  আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটা আদালত অবমাননার শমিল এবং সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এটাও বলেছে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন সাপেক্ষে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারাপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না।”

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুহিবুল ইসলাম চৌধুরী নওফেল বলেন, “বিএনপি একজন দণ্ডিত  ও পলাতক আসামির মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নেওয়ার যে কাজটি করছে, তা শুধু অবৈধই নয়, অনৈতিকও বটে।”

এর পাল্টায় বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, “আমাদের দলের মধ্যে আমি কীভাবে সাক্ষাৎকার নেব, সেটাতে তাদের কোনো এখতিয়ার আছে বলে আমি মনে করি না।”

কী বলছে ইসি

রফিকুল ইসলাম

তারেকের বিষয়ে প্রশ্ন করলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, একজন দণ্ডিত আসামি দেশে থাকলে তিনি হয় কারাগারে থাকবেন, অথবা পলাতক। কেউ কারাগারে থাকলে এ ধরনের কাজ করতে পারেন না। জেল থেকে জামিনে এসে করলে কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এই ক্ষেত্রটা একবারে ভিন্ন। আইনের মধ্যে কী আছে সেটা দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

“যদি কেউ তথ্য-প্রমাণসহ আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, তাহলে আইনের মধ্যে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বলব। আর আইনের মধ্যে যদি কিছু না থাকে, তাহলে আমরা কমিশনের সাথে বসে কী করতে পারি, তা পর্যালোচনা করে দেখে তারপর সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেব।”

সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “সিইসি মহোদয়ের কাছে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। সোমবার বিষয়টি কমিশনে উপস্থাপন করা হবে। সিইসি মহোদয় এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত দেন, তা আলোচনা করে জানানো যাবে।”

এটা অপরাধ: অ্যাটর্নি জেনারেল

দণ্ডিত তারেকের দলের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেলখানায় বন্দি দণ্ডিত কোনো আসামির সঙ্গে অবৈধ উপায়ে কেউ যদি যোগাযোগ করে, সেটা যদি অপরাধ হয়, তবে তারেক রহমানের সঙ্গে যে ধরনের যোগাযোগই হোক না কেন, সেটা অপরাধ। যেহেতু তিনি দণ্ডিত এবং পলাতক।”

অপরাধের ধরন কী- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কোন ধারায় অপরাধ, তা দেখে বলতে হবে। তবে সেটা অপরাধ।”

বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন গ্রহণ হয়নি

তারেক রহমান

বিএনপির গঠনতন্ত্রে আনা সংশোধনী নিয়ে হাই কোর্টের এক আদেশের ফলে দুর্নীতিতে দণ্ডিত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দলীয় নেতৃত্বে রাখার পথও আটকে আছে।

খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের রায় হওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে বিএনপি ইসিতে তাদের সংশোধিত গঠনতন্ত্র দিলেও বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে বলে গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান ইসি সচিব হেলালুদ্দীন।

৩১ অক্টোবর বিএনপির গঠনতন্ত্রে আনা সংশোধনী নিয়ে হাই কোর্টের এক আদেশ দেয় আদালত। ওই আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ওই সংশোধনীর মাধ্যমে মূলত বিএনপির গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারা বাদ দেওয়া হয়, যেখানে বলা ছিল, দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির নেতা বা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাক্ষরে ওই সংশোধিত গঠনতন্ত্র ইসির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় দুর্নীতি মামলার সাজায় তার কারাগারে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে।