সংকট আরও কঠিন, আরও ভয়াবহ: ফখরুল

সংলাপে দাবি আদায়ের আশা ফিকে হয়ে আসার পর রাজশাহীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংকট ‘আরও কঠিন’ রূপ পেয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2018, 11:46 AM
Updated : 9 Nov 2018, 03:24 PM

সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা না হলে তফসিল বা নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য হবে না’ বলেও সরকারকে হুঁশিয়ার করেছেন তিনি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন শুক্রবার রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে ঐক্যফ্রন্টের এই জনসভা হয়।

জনসভার প্রধান বক্তা মির্জা ফখরুল বলেন, “সময় খুব সংকীর্ণ, সংকট আরও কঠিন, আরও ভয়াবহ। আজকে প্রশ্ন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না। আজকে প্রশ্ন বাংলাদেশ স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি পারবে না। আমাদের অধিকার, আমাদের কথা বলার অধিকার, ভোট দেওয়ার অধিকার, সংগঠন করার অধিকার থাকবে কি থাকবে না, একটি মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে এই বিএনপি নেতা বলেন, “আমারাদের কথা খুব স্পষ্ট। নির্বাচনের সমান মাঠ তৈরি করতে হবে, সকল দলকে সমান অধিকার দিতে হবে। দেশনেত্রী বেগম খালদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে তাকে কাজ করতে দিতে হবে। অন্যথায় কোনো নির্বাচন, তফসিল গ্রহণযোগ্য হবে না।

ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন অসুস্থতার কারণে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে আসতে না পারলেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার বক্তব্য জনসভায় শোনানো হয়। 

তিনি বলেন, ‘‘ তড়িঘড়ি তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এটা জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, এটা সংবিধান পরিপন্থি, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ হয়েছে বলে আমরা মনে করি।”

বিএনপি চেয়ারপারসনের ‍উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মিজানুর রহমান মিনুর সভাপতিত্বে শুক্রবার বেলা ২টায় ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মধ্য দিয়ে এ সভার কার্য্ক্রম শুরু হয়। শেষ হয় বিকাল সোয়া ৫ টায়।

এই জনসভায় অংশ নিতে জুমার নামাজের পর থেকেই নেতাকর্মীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে মাদ্রাসা মাঠে আসতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে মানুষের ভিড় মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের সড়ক-গলিতে পৌঁছায়। জোটের সাত দফা দাবি নিয়ে এই জনসভা হলেও নেতা-কর্মীদের অনেকে হাতে দেখা যায় বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ ও জাতীয় পতাকা। 

জনসভায় বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে স্লোগান দেন নেতা-কর্মীরা। মাঠের দুই দিকের দেয়ালের কাছে দেখা যায় জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত বেশ কিছু ডিজিটাল ব্যানার। আর সভামঞ্চের ব্যানারে জোটের সাত দফা দাবির বিষয়টি লেখা ছিল।

খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মত দাবি রয়েছে ওই সাত দফার মধ্যে। এসব দাবি নিয়ে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকার পর রাজশাহীতে ঐক্যফ্রন্টের চতুর্থ জনসভা হল।

জনসভায় সরকারের ‘দমননীতির’ সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে মামলা-মোকাদ্দমা দিয়ে সারাদেশকে অস্থির করে তুলেছে। এটা ছাড়া তাদের কোনো অস্ত্র নাই। মামলা একটা অস্ত্র পেয়েছে, সেই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করতে চায়। ঘায়েল যে করতে পারেনি আজকে জনসভাই তার প্রমাণ।”

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “তারেক রহমান আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি আজকে বিদেশে নির্বাসিত। মিথ্যা মামলায় তাকে সাজা দিয়ে সেখানে নির্বাসিত করে রাখা হয়েছে। আজকে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।”

রাজশাহী বিএনপির নেতা আবুল খায়ের চাঁদসহ কারাবন্দি সকল নেতাকর্মীকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান ফখরুল।

জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, ‘‘জেগেছে জনতা। সরকারকে বলব, দেখে যান রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠ। পুলিশ দিয়ে রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দিয়েছেন, তারপরও মাদ্রাসা মাঠে জায়গা নাই।”

তিনি বলেন, “আমাদের স্পষ্ট কথা, দাবি মানতে হবে। জান দেব, দাবি আদায় করে ছাড়ব। এবার আর রক্ষা নাই। এবার হবে ভোটের লড়াই, এ লড়াই গণতন্ত্রের। এ লড়াই জিততে হবে।”

খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সাত দফা দাবিতে জোটের চলমান আন্দোলন সারাদেশে ‘গ্রামে-গঞ্জে’ ছড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানান রব।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এলডিপির সভাপতি অলি আহমেদ ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও না দিলেও রাজশাহীর জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। 

তিনি বলেন, “নির্বাচন হবে কিনা, নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করব কিনা এখনো সেই সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা হচ্ছে আমাদের বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে হবে।”

সাবেক এই বিএনপি নেতা তরুণদের উদ্দেশে বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যেভাবে জান দিতে গিয়েছিলাম, আপনাদেরকে সেই জান দেওয়ার কথা বলব না। কিন্তু রাস্তায় তো সকলে দাঁড়াতে পারেন বেগম জিয়ার জন্য। একটু হাত তুলে প্রশাসনকে দেখান, প্রধানমন্ত্রী দেখুক- কতগুলো হাত, কতগুলো লোক।… একটু জোরে তালি বাজান, সরকার শুনুক।”

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী জোটের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা যদি খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চান, তাহলে ঐক্যফ্রন্টকে অটুট রাখতে হবে। বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য ছটফট করলে হবে না, আপনাদের লড়তে হবে।”

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আজকের জনসভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির শ্লোগান উঠেছে। কিন্তু একবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ফ্রন্টের নেতাদের পক্ষে শ্লোগান ওঠেনি।

“আমি মনে করি বাংলাদেশের রাজনীতি বলতে খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে এমন কোনো জায়গা নেই তাকে বন্দি করে রাখা সম্ভব। খালেদা জিয়ার মুক্তি হবেই।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া, বিএনপিকে ছাড়া এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ছাড়া আগামী নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক হতে পারে না’।

“এখন আমাদের দায়িত্ব শেখ হাসিনার বাক্স থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করা। আসুন আমরা যে ৭ দফা দিয়েছি, সেই ৭ দফার আন্দোলন চালিয়ে যাই। এই দাবি পূরণের মাধ্যমেই আগামীতে দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে ইনশাল্লাহ।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, ‘‘আমরা সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে আলোচনার পথ বেছে নিয়েছিলাম, কিন্তু সংলাপ সফল হয়নি। কারণ এই সরকার ক্ষমতা ছাড়তে চায় না।”

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। সরকারকে বিনা চ্যালেঞ্জে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মত আর কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।”

মির্জা আব্বাস বলেন, “আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। কিন্তু সরকার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তাতে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয়।”

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, “সিলেটে চাইলাম আলিয়া মাদ্রাসা দেননি, চট্টগ্রামে লালদিঘী ময়দানে চাইলাম দিলেন রাস্তায়। রাজশাহীতেও পুলিশ হয়রানি করেছে। আমার গাড়িও আটকে দেওয়া হয়েছে। এই পুলিশি হয়রানি বন্ধ করুন।”

নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “আমরা কোনো হিংসা চাই না। ভোটের মত ভোট করেন, আমরা ভোট করতে চাই। পারবেন না সবাই? নৌকা যাতে জিততে না পারে তার জন্য ভোট দেবেন না।… ঘর থেকে বেরুবেন না, ওই নৌকার পতন ঘটিয়ে তবেই ছাড়ব, সেই পথে আমাদের যেতে হবে।”

নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, “২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন না করে ২৩ জানুয়ারি করলে সমস্যা কোথায়? তফসিল বদলান। মাত্র ১০ দিনের মধ্যে তিনশ আসনে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। আমরা আন্দোলন করছিলাম সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে। আর আপনারা এমন একটা ফাঁদ পেতেছেন যাতে আমরা নির্বাচনে যেতে না পারি। ওই ফাঁদ, ওই বেড়াজাল, ওই অত্যচার ছিন্নভিন্ন করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”

বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মিজানুর রহমান মিনুর সভাপতিত্বে এবং রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলনের পরিচালনায় এ জনসভায় জেএসডির আবদুল মালেক রতন, এম এ গোফরান, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, জগলুল হায়দার আফ্রিক, মোশতাক আহমেদ, রফিকুল ইসলাম প্রতিক, নাগরিক ঐক্যের এসএম আকরাম, শহীদুল্লাহ কায়সার, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের হাবিবুর রহমান তালুকদার বক্তব্য দেন।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, আমীনুল হক, আমানউল্লাহ আমান, অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, হাবিবুর রহমান হাবিব, কামরুল মুনির, আবদুস সালাম, হারুনুর রশীদ, নাদিম মোস্তফা, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, রাজশাহীর সাবেক সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সাবেক সাংসদ সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়া।

এছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ২০ দলীয় জোটের শরিক এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জমিয়তের উলামায়ের ইসলামের মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, বিকল্পধারা বাংলাদেশের একাংশের শাহ আহমেদ বাদলও বক্তব্য দেন জনসভায়।

জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের (পিপিবি) আহবায়ক রিটা রহমানকে এ জনসভায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার তার দল ২০ দলীয় জোটে যোগ দেয়।

বিএনপির হেলালুজ্জামান লালু, আবদুল লতিফ খান, আবদুল মান্নান তালুকদার, সিরাজুল হক, মাহমুদা হাবিবা আবদুল মমিন তালুকদার খোকন, আকবর আলী, সেলিম রেজা হাবিব, নজরুল ইসলাম আজাদ, ইশতিয়াক আজিজ ‍উলফাত, হাসান জাফির তুহিন, ভিপি সাইফুল ইসলাম, প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা,  রফিকুল করিম খান পাপ্পু, ফয়সাল আমিন, মজিবুর রহমান, আনোয়ার হোসেন বুলু, পারভেজ আরিফিন সিদ্দিকী, জনগোমেজ, দেবাশীষ রায় মধু, খায়রুন্নাহার, শায়রুল কবির খান, শামসুদ্দিন দিদারও উপস্থিত ছিলেন জনসভায়।