হাসিনাকে আদালতে ডাকা হচ্ছে না কেন: শুনানিতে খালেদা

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নাইকো দুর্নীতি মামলায় আদালতে হাজির করার দাবি তুলেছেন এ মামলার প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2018, 01:11 PM
Updated : 8 Nov 2018, 01:11 PM

বৃহস্পতিবার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বসানো নবম বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে এক দশক আগের এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা ওই দাবি তোলেন।

বিচারক মাহমুদুল কবিরকে উদ্দেশ্য করে খালেদা বলেন, “এ মামলার ঘটনায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জড়িত ছিলেন। তিনি আসামিও ছিলেন। তাকে কেন আদালতে ডাকা হচ্ছে না?”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রেখে এক মাস চিকিৎসা দেওয়ার পর খালেদা জিয়াকে বৃহস্পতিবার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। 

তার আগে বুধবার এ মামলার কার্যক্রম বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাস থেকে কারাগারের ভেতরে বসানো অস্থায়ী এজলাসে স্থানান্তরের আদেশ দেয় সরকার।

বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে নাইকো দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়। মামলার অন্যতম আসামি মওদুদ আহমদের অব্যাহতির আবেদনের আংশিক শুনানি শেষে বিচারক ১৪ নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে শুনানি মুলতবি করেন।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করার অভিযোগে ২০০৭ সালে ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ছাড়া মামলার অপর আসামিরা হলেন- সাবেক মন্ত্রী মওদুদ আহমদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।

গতবছর এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরুর পর খালেদা জিয়া ও মওদুদ আহমদ ছাড়া বাকি সবার অব্যাহতির আবেদনের শুনানি আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করতে না পারায় এবং মওদুদের সময়ের আবেদনে এ শুনানি আটকে ছিল গত প্রায় এক বছর ধরে।  

বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে নিয়ে আসার পর হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাকে আদালত কক্ষে হাজির করা হয়।

মওদুদ আহমদ এদিনও সময়ের আবেদন করে বলেন, তাকে শুনানির জন্য যথেষ্ট কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়নি। এ বিষয়ে হাই কোর্টে তার একটি আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।

“এখোনো সেটার শুনানি করতে পারিনি। আমার দোষে নয়। আমি কথা দিচ্ছি হাই কোর্ট যদি সেটা খারিজ করে তবে আপিল বিভাগে যাব না।”

এ সময় সময়ের আবেদনের বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, মওদুদ বার বার সময়ের আবেদন করায় এ মামলা এগোচ্ছে না।

মওদুদ তখন বলেন, “হঠাৎ করে এ রকম আদালতে এ মামলা এল। এখানে নরমাল পরিবেশ নেই। এখানে তো বসারও জায়গা নেই, দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। এখানে বাথরুম টয়লেট নেই। এটা কি আদালত হল? এখানে কেন বিচার চলবে তা আমার বোধগম্য না।”

বিচারক তখন মওদুদকে মওদুদকে শুনানি করতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “আপনার শেষ হলে ম্যাডামের শুনানি শুরু করা যায়। আপনি না করলে মামলা এগোবে না, ম্যাডামের কষ্ট আরও বাড়বে।”

আদালত সময়ের আবেদন নাকচ করে দিলে ব্যারিস্টার মওদুদ নিজেই নিজের অব্যাহতির আবেদনের শুনানি শুরু করেন।

এক ঘণ্টা দশ মিনিটের শুনানিতে মওদুদ বলেন, নাইকো চুক্তির অনুমোদন হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আগের (আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদ) সরকারের আমলে ।

“আমরা আগের সরকারের সিদ্ধান্ত কনটিনিউ করেছি মাত্র। এটা নিয়ম। উনারা (আগের সরকার) অনুমোদন (অ্যাপ্রুভ) করার পর আমাদের সময় শুধুমাত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর হয়েছে। এটা ধারাবহিকতা। আমি নিজে কোনো মতামতে সই করিনি। চুক্তিতে আরও আট জনের স্বাক্ষর রয়েছে।”

মওদুদ বলেন, “এ মামলার আগে একই রকম মামলা হয়েছিল, সেখানে বর্তমান প্রাধানমন্ত্রীও আসামি ছিলেন। ওই মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র হুবুহু এক; সে মামলায় তারা অব্যাহতি পেয়েছেন।”

শুনানির এ পর্যায়ে হুইল চেয়ারে বসা খালেদা জিয়া বলেন, “আমরা যদি অ্যাপ্রুভ না করতাম তবে এখন উনারা (আওয়ামী লীগ সরকার) বলতেন কেন অনুমোদন দেননি?”

বিচারককে তিনি বলেন, “বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জড়িত ছিলেন। তাকে হাজির করা উচিৎ। তাকে হাজির করে তার ব্যাখ্যা নেন।”

এ কথার উত্তরে বিচারক মাহমুদুল কবির বলেন, “এ মামলায় তিনি আসামি নন। কাজেই তাকে হাজির করার প্রশ্ন আসে না।”

নাইকোকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার অভিযোগে খালেদার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও একই দিনে আরেকটি মামলা করেছিল দুদক।

আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০১০ সালের মার্চে হাই কোর্ট ওই মামলা বাতিল করে দেয়। রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই মামলাটি করা হয়েছিল।

বিচারিক আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ‘বেআইনি কাজ’করেছে উল্লেখ করে উচ্চ আদালত ওই রায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের বিধিমালাও সংশোধন করতে বলেছিল।

বেলা ১১টা ৫০ মিনিট থেকে ১২টা ১০ পর্যন্ত শুনানি করে মওদুদ বলেন, “আমি ক্লান্ত। আর পারছি না। আমার বয়স এখন ৮১। সিক ফিল করছি।”

তার এ কথায় দুদকের আইনজীবী কাজল বলেন, “আজ শেষ করে যেতে হবে। আর সময় নেবেন না।”

এ সময় খালেদা জিয়া বলে ওঠেন- “এত তাড়াহুড়ো কেন?”

মওদুদ তখন কাজলকে বলেন, “আপনি কি ফোর্স করছেন?”

কাজল তখন বলেন, “আমিও তো অসুস্থ, তারপরও তো শুনানিতে এসেছি। আমি বেইসবল খেলতে গিয়ে চোখে আঘাত পেয়েছি। এ জন্য কালো চশমা পড়ে এসেছি। আমি এ বয়সে ক্রিকেটও খেলি।”

খালেদা ও মওদুদের অপর আইনজীবী বোরহান উদ্দিন এ সময় রুশ সাহিত্যিক ইভান তুর্গেনেভের একটি উপন্যাসের কাহিনী তুলে ধরে বলেন, “বিচারক, আইনজীবী সবাই মিলেই বিচারে বসতে হয়। সবার সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আইনি সমঝোতায় বিচার চলে।”

বিচারক মওদুদের শুনানি মুলতবির আবেদনে সম্মতি দিতে গেলে কাজল বলেন, “তাহলে আগামী রোববার তারিখ রাখা হোক মওদুদ সাহেবের বাকি শুনানির জন্য । ম্যাডামের পক্ষেও সেদিন শুনানি করতে হবে।”

আসামি পক্ষের আইনজীবীরা তখন বৃহস্পতিবার শুনানির তারিখ রাখার কথা বলেন।  বিচারক মাঝামাঝি সিদ্ধান্ত টেনে তারিখ রাখেন আগামী ১৪ নভেম্বর। 

এদিন শুনানি চলার মধ্যেই আদালত কক্ষে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর। শুনানি শেষে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া ‘অসুস্থ’ থাকার পরও তাকে কারাগারে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

“তাকে অন্যায়ভাবে হাসপাতাল থেকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডে যেসব চিকিৎসক দায়িত্বে ছিলেন, তারা তাকে ছাড়পত্র দেননি। অন্য একজনের মাধ্যমে ছাড়পত্র লেখানো হয়েছে।”

অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, খালেদা জিয়াকে দেখে তার সুস্থই মনে হয়েছে।

“বেগম খালেদা জিয়াকে হসপিটাল থেকে এখানে আনা হয়েছে এবং রিলিজ অর্ডারের মাধ্যমে এখানে আনা হয়েছে। ডক্টর যারা আছেন, যারা তাকে রিলিজ দিয়েছেন, তারা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। বাট অ্যাজ এ প্রসিকিউটর, আমি আদালতে তাকে দেখেছি ভালো, উৎফুল্ল… তিনি বসে ছিলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে (প্রশ্নের) জবাব দিয়েছেন, কথাবার্তা বলেছেন।”