সংলাপে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির ঐক্য ঝালাই

সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেদিন কাদের সিদ্দিকীর দলকে নিয়ে জোটের পাল্লা ভারী করেছে, সেদিন জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ করে নিজেদের ঐক্য মজবুত করল আওয়ামী লীগ।

নিজস্ব প্রতিবেদকজ্যেষ্ঠ ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2018, 01:28 PM
Updated : 5 Nov 2018, 06:06 PM

সোমবার গণভবনে সংলাপ শেষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি উভয় দলের নেতাদের কথায় প্রকাশ পেয়েছে আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে তাদের অভিন্ন অবস্থানের কথা।

সংলাপের শুরুতেই দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগের সহযোগিতার জন্য জাতীয় পার্টিকে ধন্যবাদও জানান প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানও কোনো দাবি-দাওয়া তুলে না ধরে নির্বাচন প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের মনোভাব জেনে নিয়েছেন।

নির্বাচন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে মতবিরোধের মধ্যে কামাল হোসেনের উদ্যোগে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের সংলাপে ডাকেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

সংলাপে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে, সংসদ ভেঙে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সাত দফা দাবি জানায় ঐক্যফ্রন্ট। প্রথম দফা সংলাপে দাবি পূরণে সমাধান না পেয়ে দ্বিতীয় দফায় বসতে যাচ্ছে তারা।

এদিকে ঐক্যফ্রন্টকে ডাকার পর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও গণভবনে আমন্ত্রণ জানান শেখ হাসিনা; সেই ধারায় সোমবার সংলাপে বসেন এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির নেতারা।

গণভবনে যাওয়ার দুদিন আগেই এরশাদ বলেছিলেন, তিনি সংলাপ করতে নন, আসন্ন নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি বিষয়টি সুরাহা করতে যাবেন।

সংলাপ শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেছেন, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে তারা আলোচনা করেছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বিকল্প ধারার মতো তাদের কোনো দাবি ছিল না।

সংলাপে অংশ নিতে গণভবনে ঢুকছেন এইচ এম এরশাদসহ জাতীয় পার্টির নেতারা

জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের গণভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা একমত হয়েছি যে বর্তমান সংবিধানের আলোকে যে ধরনের বিধান আছে, সেই অনুযায়ী সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।”

একই কথা আওয়ামী লীগও বলে আসছে; যা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব ঘুচছে না।

জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ শেষে বিএনপির আন্দোলনের হুমকির বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “তাদের দৌড় কতটুকু, তা আমাদের জানা আছে।”

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আগামী ভোটে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার কথাও বলেন। তিনি ইঙ্গিত দেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ২০১৪ সালের মতোই আলাদা নির্বাচন করবে, আর বিএনপি এলে হবে ২০০৮ সালের মতো জোটবদ্ধ নির্বাচন।

“যেভাবে মেরুকরণ হবে রাজনীতিতে, সেভাবেই সমীকরণ হবে জোটে,” সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।

সংলাপ শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন জি এম কাদের। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

একই প্রশ্নে এরশাদের ভাই জি এম কাদের বলেন, “এই পর্যন্ত আমরা আগের অবস্থানেই আছি। সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আমরা মহাজোটের সঙ্গে নির্বাচন করব, এটাই আমরা একমত হয়েছি। কোনো কারণে যদি সব দল নির্বাচনে না আসে, তাহলে আমরা হয়ত তিনশ আসনে নির্বাচন করব।”

বিএনপিবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আলাদা নির্বাচন করে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসন নিলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরকারেও অংশ নেয়। এরশাদ নিজেও হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।

তবে নানা সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গ ছাড়ার কথা এরশাদ মুখে বললেও তা বাস্তবে দেখা যায়নি। একে আসন বণ্টন নিয়ে দর কষাকষিতে নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবেই দেখেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তবে সোমবারের সংলাপে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি।

সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি ওবায়দুল কাদের। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেন, “১৪ দল বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরবর্তীতে আলোচনায় এটা ঠিক করা হবে।”

জি এম কাদের আশ্বাস পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, “সুনির্দিষ্ট কোনো আসন আমরা চাইনি এবং উনারাও সেভাবে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। আমরা কত আসন চাইব, কত আসন দেবে, এটা নিয়ে পরবর্তীতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে।”

সংলাপ শেষে দলীয় কার্যালয়ে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব হাওলাদার বলেন, “আমাদের চেয়ারম্যান বলেছেন, যে অর্থে অন্য দুটি জোট আপনার সাথে সংলাপে বসেছে, আমি সে অর্থে সংলাপ করতে আসিনি। আমরা এসেছি আপনার সাথে একাদশ জাতীয় সংসদ নিয়ে কিছু খোলামেলা আলোচনা করতে। কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে আসি নাই। নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন, তা জানতে এসেছি।”

গণভবনে সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় পার্টির সংলাপ শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন দলটির জ্যেষ্ঠ কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এরশাদ আটটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন বলে জানান হাওলাদার। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার না করা, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি।

নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে এরশাদ স্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছেন বলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জানান।

তিনি বলেন, “চেয়ারম্যান বলছেন, নির্বাচন করতে হবে অবশ্যই সংবিধানের আওতায়। অনির্বাচিত তথাকথিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় তিক্ত  অভিজ্ঞতা জাতীয় পার্টি ভোগ করেছে। ওয়ান-ইলেভেনের সরকার শীর্ষ রাজনীতিক নেতাদের রাজনীতি থেকে মাইনাস করার চেষ্টা করেছে। সেই অন্ধকার ‍যুগে আর আমরা ফিরে যেতে পারব না।”

গণভবনে সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় পার্টির সংলাপ শেষে দলীয় কার্যালয়ে ফিরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি দলটির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার

সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোর অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় পার্টি।

এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও কোনো দল যদি নির্বাচনে না আসে, তা আর দেখার অবকাশ নেই।

নির্বাচনকালীন সেনা মোতায়েন হলেও তাদের যেন বিচারিক ক্ষমতা না দিতে বলেছেন সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ। জনগ অভ্যস্ত না হওয়ায় এখনই ইভিএম ব্যবহার না করার সুপারিশ করেছেন তিনি।

হাওলাদার বলেন,  “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আমাদের প্রস্তাবগুলো সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবেন। পরে হয়ত তার সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ করব।”

আগামী ৭ নভেম্বরের পর সংলাপের সুযোগ নেই বলে ওবায়দুল কাদেরের ইতোপূর্বকার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় হাওলাদার বলেন, “৭ তারিখের পরে আলোচনা হবে না কেন? যে কোনো সময়  আলোচনা হতে পারে, তবে তা চলমান সংলাপের অংশ নয়। আলোচনা চলমান প্রক্রিয়া।”

শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, “আপনারা অপেক্ষা করেন......আরও কিছু চমক আসবে.. সারপ্রাইজ আসতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”