দণ্ডিত খালেদা-তারেককে দলীয় নেতৃত্বে রাখার পথ আটকে গেল

বিএনপির গঠনতন্ত্রে আনা সংশোধনী নিয়ে হাই কোর্টের এক আদেশের ফলে দুর্নীতিতে দণ্ডিত খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে দলীয় নেতৃত্বে রাখার পথ কার্যত আটকে গেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2018, 07:45 AM
Updated : 31 Oct 2018, 01:44 PM

নয় মাস আগে আনা ওই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে মোজাম্মেল হোসেন নামে এক ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনে একটি আবেদন করেছিলেন। ওই আবেদন এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলেছে হাই কোর্ট।

আর ওই আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গঠনতন্ত্র সংশোধনের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে মোজাম্মেল হোসেনের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন এই আদেশ দেয়।

ওই সংশোধনীর মাধ্যমে মূলত বিএনপির গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারা বাদ দেওয়া হয়, যেখানে বলা ছিল, দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির নেতা বা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। 

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাক্ষরে ওই সংশোধিত গঠনতন্ত্র ইসির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় দুর্নীতি মামলার সাজায় তার কারাগারে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে।

হাই কোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন ওই আদেশের ফলে গঠনতন্ত্রের ওই সংশোধনী আপাতত কার্যকর থাকছে না। তাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলীয় নেতৃত্বে রাখা এবং নির্বাচনে তাদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগও আটকে যাচ্ছে।

আদালতে রিটকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন মেহেদী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম মাসুদ রুমি।

আদেশের পর মাসুদ রুমি সাংবাদিকদের বলেন, “মোজাম্মেল হোসেন বলেছেন, তিনি একজন বিএনপি কর্মী। গতকাল ইসিতে তিনি একটি আবেদন দিয়েছেন যাতে বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা না হয়।

“তিনি বলেছেন, এই গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হলে বিএনপিতে দুনীর্তিবাজ, অযোগ্য ব্যক্তিরা নেতা হওয়ার সুযোগ পাবেন। আদালত তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে রুল ও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছেন।”

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, মোজাম্মেল হোসেন নামের ওই ব্যক্তি মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনে এসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবরে লেখা আবেদনপত্রটি জমা দেন। সেখানে বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুমোদন না করার আবেদন করা হয়।

মোজাম্মেলের আবেদনে বলা হয়, বিএনপির ‘নীতি ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে’ তিনি ওই দলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সপ্তম ধারা বাদ দিয়ে দলের গঠনতন্ত্রে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে ‘জাতীয়তাবাদী আদর্শে উজ্জীবিত’ কর্মী হিসেবে তিনি ‘বিস্মিত ও হতবাক’।

হাই কোর্টের আদেশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও আদেশটি হাতে পাইনি। আমরা জেনে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।”

তড়িঘড়ি সংশোধন

দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদের দলীয় কমিটিতে না রাখার যে বিধান বিএনপির গঠনতন্ত্রে ছিল, সংশোধনীতে তা বাদ দেওয়া কেন বেআইনি হবে না এবং সংবিধানের ৬৬ (২) ঘ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি হবে না- রুলে তা জানতে চেয়েছে আদালত।

চার সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয় সরকার সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

দুর্নীতির দুই মামলায় ১০ ও ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত আট মাস ধরে কারাবন্দি। আর তার বড় ছেলে তারেক রহমান দুর্নীতির দুই মামলায় ৭ ও ১০ বছর এবং হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার রায় মাথায় নিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের আইনের দৃষ্টিতে তিনি এখন পলাতক।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় কারও ন্যূনতম দুই বছর কারাদণ্ড হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন। কিন্তু বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ ও নজির রয়েছে।

কিন্তু বিএনপির গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারায় খালেদা জিয়ার জন্য আরও একটি বিপদ লুকিয়ে ছিল। সেখানে বলা ছিল, দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির কোনো পর্যায়ের কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন।

সেই বিপদ এড়াতে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের আগে গত ২৮ জানুয়ারি সপ্তম ধারা বিলুপ্ত করে বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিলে এসব সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নিবন্ধিত হওয়ার সময় দলীয় গঠনতন্ত্র জমা দিতে হয়। আর সংশোধন করা হলে তা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হয়। কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হল কি না, তা দেখা ইসির দায়িত্ব।

বিএনপির গঠনতন্ত্রের ওই পরিবর্তন নীতিসিদ্ধ হয়েছে কিনা- সেই প্রশ্নে সে সময় কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে সে সময় তিনি বলেছিলেন, “আমরাতো তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করব না। তারা গঠনতন্ত্র সংশোধন করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে।”

তবে সপ্তম ধারা বিলোপের ওই সিদ্ধান্ত যে দুর্নীতি নিয়ে বিএনপির দলীয় অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক- সে বিষয়টি সে সময় একাধিক বিশ্লেষকের মন্তব্যে আসে। 

ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়া

বিএনপির নেতৃত্বে খালেদার তিন যুগ

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে পরের বছর রাজনীতিতে নেমে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। ১৯৮৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। সেই থেকে তিনি এই পদে রয়েছেন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দুইবার ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

এক যুগ আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব হন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান।

লন্ডনে থাকা অবস্থাতেই ২০০৯ সালের কাউন্সিলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেকের পদোন্নতি ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসের মীমাংসিত কিছু বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য হাই কোর্ট বাংলাদেশে তারেকের বক্তব্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি আদালত খালেদা জিয়াকে এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে পাঠালে বিএনপির ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী’ বিদেশে থাকা তারেককেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কী করবে বিএনপি?

বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন নিয়ে হাই কোর্টের আদেশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের তো মামলায় পক্ষ করেনি। আমরা জানিই না। আজ আমাদের ধর্মঘট চলছিল। ধর্মঘট শেষ হওয়ার পর এটি জানতে পারলাম।”

এ বিষয়ে বিএনপি কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা দেখছি, কীভাবে কোন পরিপ্রেক্ষিতে আদেশটা হল। রিট পিটিশন কীভাবে হল। বিএনপি একটা রাজনৈতিক সংগঠন। এই রাজনৈতিক সংগঠনের গঠনতন্ত্র নিয়ে কেন রিট হল- এটা আমাদের এক্সামিন করে দেখতে হবে। তারপরে আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাববো।”

অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলের পদে দণ্ডিত কেউ থাকতে পারবে না এটাই তো স্বাভাবিক। সমস্ত দুনিয়ার সব রাজনৈতিক দলের এটাইতো নৈতিক স্ট্যান্ডার্ড। এটাইতো ছিল। এখন এটা যদি পরিবর্তন করা হয়, তাহলে সঠিকভাবেই নির্বাচন কমিশনের উপরে নির্দেশ চাওয়া হয়েছে, তারা যাতে এটা গ্রহণ না করে। এটা গ্রহণ করার অর্থ হবে-দুর্নীতির সঙ্গে আপস করা।”

হাই কোর্টের এই আদেশের পরে খালেদা ও তারেক দলের পদে থাকতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সংশোধিত গঠনতন্ত্র যদি নির্বাচন কমিশন গ্রহণ না করে তাহলে পারবে না। আর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন এরকম কোনো জিনিস গ্রহণ করতে পারে না।”

সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকের প্রশ্নে একই ধরনের মত প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “হাই কোর্ট যে আদেশটি দিয়েছে, তাতে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান নৈতিকভাবে পদে থাকতে পারেন না। কারণ তারা দণ্ডিত।”

শফিক আহমেদ বলেন, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে যদি দুই বছরের বেশি সাজা হয়, তাহলে সংবিধানের ৬৬(২) ধারা অনুযায়ী সাজা ভোগ করার পরে আরও ৫ বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যায় না।

“আর এখানে কী করে তারা একটা দণ্ডিত লোককে বা এই ধরনের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে এমন ব্যক্তিকে দলীয় পদে রাখে? আমি মনে করি হাই কোর্ট যথাযথ আদেশ দিয়েছে।”