এতিমখানা দুর্নীতি: খালেদার আপিল রায় মঙ্গলবার

বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় হাই কোর্টে বহাল থাকবে কি না সে সিদ্ধান্ত জানা যাবে মঙ্গলবার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2018, 10:19 AM
Updated : 30 Oct 2018, 04:30 AM

সোমবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ আপিল শুনানি শেষে রায়ের জন্য মঙ্গলবার দিন ঠিক করে দেয়।

এ মামলার অর্থের উৎস স্পষ্ট করতে অতিরিক্ত সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন করেছিলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। সোমবার হাই কোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষে এদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহমেদ ও দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের কেউ আদালতে ছিলেন না।

এ মামলার আপিল নিষ্পত্তির জন্য আরও সময় চেয়ে করা খালেদা জিয়ার পুনির্বিবেচনার আবেদনটি সোমবার সকালে আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়। ফলে আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩১ অক্টোবরের মধ্যেই এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আপিল শুনানি শেষ করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।

অতিরিক্ত সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে খালেদা জিয়ার যে আবেদনটি এর আগে নথিভুক্ত করে রেখেছিল হাই কোর্ট। আপিল বিভাগ সেটি এক দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে সকালে ওই আদেশ আসার পর হাই কোর্ট দুপুরে নথিভুক্ত আবেদনটির বিষয়ে শুনানির জন্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ডাকেন।

“কিন্তু উনারা কেউ এলেন না। আদালত তখন নথিভুক্ত আবেদনটি খারিজ করে দিলেন এবং আগামীকাল এ মামলার তিনটি আপিল এবং একটি রিভিশন আবেদন রায়ের জন্য রাখলেন। এখন রায় রিসিভ করার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।”   

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এই আপিল আবেদনে তার খালাস চেয়েছেন। অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে যাবজ্জীবন চেয়েছেন । আর রাষ্ট্রপক্ষ বিচারিক আদালতের দেওয়া ৫ বছরের সাজাই বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়েছে।

দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এই মামলা করে দুদক।

তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ।

অভিযোগে বলা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এ মামলার আসামিরা।

মামলা হওয়ার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ বাসুদেব রায় ছয় আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করে খালেদা জিয়াসহ ছয় আসামির বিচার শুরু করেন।

দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারক আখতারুজ্জামান।

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় ক্ষমতায় থেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের’ কারণে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন তিনি। 

মামলার বাকি পাঁচ আসামি খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদকে দেওয়া হয় দশ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড।

সেই সঙ্গে আসামিদের প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন বিচারক।

রায়ে বিচারক বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বয়স ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আসামিদের মধ্যে তারেক মুদ্রা পাচারের এক মামলায় সাত বছর এবং ২১ অগাস্ট গ্রেনেড মামলায় যাবজ্জীবন সাজার রায় মাথায় নিয়ে গত দশ বছর ধরে পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। কামাল সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমানও পলাতক। সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আছেন কারাগারে।

আপিল

নিম্ন আদালতে রায় ঘোষণার ১১ দিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি (সার্টিফায়েড কপি) হাতে পান খালেদার আইনজীবীরা। এরপর হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ২০ ফেব্রুয়ারি তারা আপিল করেন।

এরপর গত ২২ ফেব্রুয়ারি খালেদার আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে তার অর্থদণ্ড স্থগিত করে হাই কোর্ট। ৭ মার্চ সালিমুল হক কামাল এবং ১০ মে শরফুদ্দিনের আপিলও শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়। ১২ জুলাই শুরু হয় আপিল ও রুল শুনানি।

এর আগে ২৮ মার্চ খালেদার সাজা বাড়াতে দুদকের করা একটি আবেদনে রুল জারি করে হাই কোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্র ও খালেদা জিয়ার কাছে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়। তবে আদালত বলে দেয়, রুলের ওপর শুনানি হবে খালেদা জিয়ার আপিলের সঙ্গে।

এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জজ আদালতের রায়ের পরপরই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় তিনিই ছিলেন পরিত্যক্ত ওই কারাগারের একমাত্র বন্দি।

পরে হাই কোর্টের আদেশে ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।  বর্তমানে তিনি সেখানেই কারা তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন।

এ মামলায় খালেদা জিয়ার আপিলের রায় হতে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায়ের পরদিন। প্রায় সোয়া ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় ওই মামলায় জজ আদালত তাকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে।

দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ায় ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা খালেদা জিয়ার আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।  

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় কারও ন্যূনতম দুই বছর কারাদণ্ড হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন। কিন্তু বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ ও নজির রয়েছে।

সে বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি (খালেদা) নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করবে আদালতের ওপর। উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন।”