দুর্নীতির আরেক মামলায় রায়ের সামনে খালেদা

দুর্নীতির দায়ে কারাগারে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আট মাসের মাথায় দ্বিতীয় দুর্নীতি মামলার রায়ের মুখোমুখি হচ্ছেন সোমবার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2018, 04:02 PM
Updated : 29 Oct 2018, 06:11 AM

ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতে এদিন জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে সোয়া তিন কোটি টাকা লেনদেনের মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে।

বেলা ১১টার পর কোনো এক সময় নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বসানো জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস থেকে বিচারক মো. আখতারুজ্জামান এই রায় ঘোষণা করবেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এ মামলার বিচার চালানোর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আপিল বিভাগে গিয়েছিলেন তার আইনজীবীরা। সোমবার সকাল ৯টার পর আপিল বিভাগ সেই লিভ টু আপিল খারিজ করে দিলে রায় ঘোষণার বাধা কাটে।  

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে বর্তমানে কারা তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রাখা হয়েছে।

অসুস্থতার কারণে তাকে আদালতে নেওয়া হচ্ছে না বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আব্দুল্লাহ-আল-হারুন।

আসামি কারাগারে থাকলে তার উপস্থিতিতেই রায় পড়ে শোনানোর নিয়ম। তবে বিচারক যেহেতু খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এ মামলার বিচার চালানোর সিদ্ধান্ত আগেই দিয়েছেন, সেহেতু রায় ঘোষণায় কোনো আইনি সমস্যা দেখছেন না অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। 

রায় ঘিরে ইতোমধ্যে ওই এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিচারকও ইতোমধ্যে আদালতে উপস্থিত হয়ে খাস কামরায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।  

কয়েকটি ধার্য তারিখে আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন না করায় গত ১৬ অগাস্ট বিচারের ওই অংশটি বাদ দিয়েই রায়ের তারিখ নির্ধারণ করে দেন বিচারক। রায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে দুর্নীতির এ মামলায় সর্বোচ্চ সাত বছরের সাজা হতে পারে বিএনপি চেয়ারপারসনসহ চার আসামির।   

খালেদাকে নির্দোষ দাবি করে তার দল বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ থেকে তাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে এই ‘মিথ্যা’ মামলা করিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।

আদালত রায়ের তারিখ ঠিক করে দেওয়ার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৬ অগাস্ট সাংবাদিকদের বলেন, “এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, সরকার যে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে এটা তারই একটি প্রমাণ।”

৬ অগাস্ট খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া হয়

বিচার পরিক্রমা

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ৮ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন।

তেজগাঁও থানার এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায় ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চার আসামির বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।

আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যায়ে থাকাবস্থায় ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকার বাসুদেব রায়কে বদলি করে, তার জায়গায় আসেন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু আহমেদ জমাদার।

পরে বিচারক আবু আহমেদ জমাদারের প্রতি খালেদার অনাস্থার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৭ মে হাই কোর্টের আদেশে মামলা স্থানান্তরিত হয় ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামানের আদালতে।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৭ সালের গত ১ ডিসেম্বর আদালতে উপস্থিত হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন খালেদা। সেখানে নিজেকে ‘সম্পূর্ণ নির্দোষ’ দাবি করে তিনি আদালতের কাছে সুবিচার চান।

তার আবেদনে কয়েক দফা এ মামলার বিচারক বদলে দেয় হাই কোর্ট। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করে বিচার বিলম্বিত করছেন বলে অভিযোগ করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা।

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বকশীবাজারে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে এতিমখানা দুর্নীতি মামলার সঙ্গেই চলছিল।

৮ ফেব্রুয়ারি একই বিচারক এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এর পরের সাত মাসে কারা কর্তৃপক্ষ খালেদাকে আদালতে উপস্থিত করতে না পারায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি দফায় দফায় পেছানো হয়। প্রতিবারই আদালতকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কথা বলা হয়। 

এই পরিস্থিতিতে ৪ সেপ্টেম্বর ‘নিরাপত্তার কারণ’ দেখিয়ে কারাগারের ভেতরেই আদালত বসিয়ে এ মামলার শুনানি শেষ করার ব্যবস্থা করে সরকার। পরদিন ওই অস্থায়ী এজলাসে হাজির করা হলে খালেদা জিয়া বলেন, তিনি বার বার আদালতে আসতে পারবেন না, বিচারক তাকে ‘যতদিন খুশি’ সাজা দিতে পারেন।

এরপর শুনানির দুটি নির্ধারিত দিনে কারা কর্তৃপক্ষ খালেদাকে আদালত কক্ষে আনতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে তার অনুপস্থিতিতেই বিচার চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেন বিচারক মো. আখতারুজ্জামান।

৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের পর কারাগারের পথে খালেদা জিয়া

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে গেলে তাদের আবেদন ১৪ অক্টোবর খারিজ হয়ে যায়। এরপর হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। সে বিষয়েও সোমবার আদেশের দিন রয়েছে।

এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্কের শুনানিতে অংশ না নিয়ে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে পাঠানোসহ বিভিন্ন আবেদন নিয়ে শুনানি করতে থাকায় দুদকের আইনজীবী কাজল যুক্তিতর্ক ছাড়াই রায়ের তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন জজ আদালতে।

সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৬ অক্টোবর বিচারক আখতারুজ্জামান রায়ের জন্য ২৯ অক্টোবর দিন ঠিক করে দেন।

সেই আদেশে তিনি বলেন, “আসামিপক্ষ নানা কারণ দেখিয়ে যুতক্ততর্ক উপস্থাপন করেন নাই, কালক্ষেপণ করেছেন। সেজন্য প্রসিকিউশন যে আবেদন করেছে সে আবেদন মঞ্জুর করা হল। আগামী ২৯ অক্টোবর এ মামলা রায়ের জন্য থাকবে। খালেদা জিয়া সেদিন পর্যন্ত জামিনে থাকবেন।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রোববার সাংবাদিকদের বলেন, জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের শুনানির সময় খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে ৪০ বার সময় নেওয়া হয়। তারপর যখন আসামি পক্ষের বক্তব্য শোনার জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হল, তখন তিনি ৩২ বার সময় নিয়েছেন।

আসামিরা

মামলার চার আসামির মধ্যে প্রধান আসামি খালেদা জিয়া এ মামলায় জামিনে থাকলেও অন্য মামলায় গ্রেপ্তার থাকায় তার মুক্তি মেলেনি। বর্তমানে তিনি কারা তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।

আরেক আসামি খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় থেকে পলাতক। তিনি দেশের বাইরে আছেন বলে ধারণা করা হয়। সম্প্রতি ২১ অগাস্ট মামলার রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান দীর্ঘদিন জামিনে থাকার পর গত সেপ্টেম্বরে তাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠান বিচারক।

অভিযোগপত্রে যা ছিল

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ‘অবৈধ উৎস থেকে’ অর্থ সংগ্রহ, কাকরাইলে জনৈক সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ৪২ কাঠা জমি কেনায় অনিয়ম এবং ট্রাস্টের নামে জমির নামজারি না করার অভিযোগ আনা হয়েছে এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, ‘শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ নামে ওই ট্রাস্ট গঠন করেন।

ওই সময়ের সেনানিবাসের বাসার ঠিকানা ট্রাস্টের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ট্রাস্টের প্রথম ট্রাস্টি খালেদা জিয়া নিজে এবং ট্রাস্টের সদস্য দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান।

এই ট্রাস্টের নামে ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ে সোনালী ব্যাংকের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন খালেদা জিয়া। এই হিসাব খোলার পর প্রধানমন্ত্রীর দাপ্তরিক ক্ষমতার প্রভাবে বিভিন্ন অবৈধ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ ও জমা করা হয়।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে ওই ট্রাস্টের নামে কোনো ধরনের কার্যক্রম বা লেনদেন করেননি সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।

দুদকের অনুমোদিত অভিযোগপত্রে বলা হয়, জমির মালিককে দেওয়া ওই অতিরিক্ত অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যা এসেছে ‘অবৈধ’ উৎস থেকে।

খালেদা জিয়া ও হারিছ চৌধুরীসহ আসামিরা ‘সরকারের পদমর্যাদা ব্যবহার করে পরস্পর যোগসাজশে’ ওই টাকা ‘অবৈধভাবে’ সংগ্রহ, জমা ও ব্যয় করেন বলে উল্লেখ করা হয় অভিযোগপত্রে।

মামলায় বলা হয়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ব্যাংক হিসাব খোলার পর সাত দিনের মধ্যে জমা হয় ৭ কোটি ৮০ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ টাকা। এর মধ্যে ৬ কোটি ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ টাকা বিএনপির দলীয় তহবিল থেকে আসে।

বাকি টাকার মধ্যে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা মেট্রো মেকার্স ডেভেলপার্স লিমিটেড এবং ২৭ লাখ টাকা জিয়াউল ইসলামের কাছ থেকে ওই হিসাবে আসে।

দুদকের অভিযোগ, বিএনপির দলীয় ফান্ডের টাকা ছাড়া বাকি টাকার কোনো বৈধ উৎস নেই। তখনকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার দাপ্তরিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে ওই অর্থ সংগ্রহ ও জমা করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মেট্রো মেকার্স ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এফ এস জাহাঙ্গীর ট্রাস্টে টাকা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম মেট্রো মেকার্সের নাম ব্যবহার করে ওই অর্থ জমা দিয়েছেন।

অন্যদিকে মনিরুল ইসলাম দুদককে বলেছেন, হারিছ চৌধুরীর দেওয়া টাকা পে অর্ডারের মাধ্যমে তিনি ওই হিসাব নম্বরে জমা দিয়েছেন। একইভাবে জিয়াউল ইসলামও বলেছেন, নির্দেশ ছিল বলেই তিনি টাকা জমা দিয়েছেন।

পুরনো খবর