বিচারপতি সিনহার বইয়ে ‘উসকানি’ দেখছেন কাদের

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে বিদেশে বসে বই প্রকাশ করে কেন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন- সেই প্রশ্ন রেখেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিগাজীপুর ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2018, 12:03 PM
Updated : 21 Sept 2018, 12:03 PM

শুক্রবার এক প্রকল্প পরিদর্শনে গাজীপুরে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এখন বইটি এ সময়ে প্রকাশ করা এবং এটাকে নিয়ে সরকারবিরোধী অপপ্রচারের যে উসকানি, তা এ সময়ে তিনি না দিলেও পারতেন।”

আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে বিচারপতি সিনহার অভিযোগকে বর্ণনা করেছেন ‘পরাজিত লোকের হা-হুতাশ’ হিসেবে।

‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে আত্মজীবনীমূলক ওই বইয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি দাবি করেছেন, তিনি দেশ ছেড়েছেন ‘হুমকির মুখে’; একই কারণে বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।   

“২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক এক রায় দেওয়ার পর বর্তমান সরকার আমাকে পদত্যাগ করতে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে।” 

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে তিনি ছুটিতে যান। সরকারের পক্ষ থেকে অসুস্থতার কথা বলা হলেও ১৩ অক্টেবর তিনি রীতিমত বোমা ফাটিয়ে বিদেশে চলে যান।

বিচারপতি সিনহা বলে যান, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি ‘বিব্রত’। তার ছুটির মেয়াদ শেষে ১১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।

পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বলা হয়, ওইসব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন।

সরকারের মন্ত্রী আর আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ করে আসছেন, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, শৃঙ্খলা বিধির নামে বিচারপতি সিনহা তা কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন।

সেই সময়ের কথা তুলে ধরে বিচারপতি সিনহা তার বইয়ে লিখেছেন, “পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী, তার দলের লোকজন এবং সরকারের মন্ত্রীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আইনমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনতে থাকেন।”

ওই সময় তাকে বাসভবনে আটকে রাখা হয় এবং আইনজীবী ও বিচারপতিদেরকে তার সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেছেন এস কে সিনহা।

বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বাধ্য হয়ে’ দেশ ছাড়ার সময় তিনি ভেবেছিলেন, আদালতে তার অনুপস্থিতি আর অবকাশের মধ্যে পরিস্থিতি থিতিয়ে আসবে; ‘সুবিবেচনার’ উদয় হবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিবার ও স্বজনরা ‘হুমকির’ মুখে পড়লে বিদেশ থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার কথা লিখেছেন বিচারপতি সিনহা।

বিচার বিভাগের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে বিএনপি; পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার লেখাকে এখন সেই অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে দেখাচ্ছেন দলটির নেতারা।

অন্যদিকে সরকারের সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সাবেক হওয়ার অন্তর্জ্বালা’ থেকেই হয়ত বিচারপতি সিনহা এখন ‘মনগড়া কথা’ বলছেন।

“তার লেখা বই তিনি প্রকাশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, তা বিদেশের মাটিতে বসে কেন?  আর নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন?”

দুই-তিন মাস পরেও বইটি প্রকাশ করা যেত মন্তব্য করে ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা বলেন, “প্রধান বিচারপতির পদ থেকে তিনি নিজেই সরে গেছেন। এখন বিদেশে গিয়ে মনগড়া তথ্য দিয়ে তিনি যদি সরকারবিরোধী মহলের অপপ্রচারের সুবিধা করার জন্য এ সময় বইটি প্রকাশ করে থাকেন, তাহলে আমার মনে হয়, তার দায়িত্বশীলতার বিষয়টি প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকবে।”

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের চারগাছ বাজারে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বিচারপতি সিনহার বই প্রসঙ্গে কথা বলেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ বইটিকে একজন ‘পরাজিত লোকের হা-হুতাশ’ আখ্যায়িত করেন।

তিনি বলেন, “যারা এসকে সিনহার মাধ্যমে জুডিশিয়াল ক্যু করার ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই পরাজিত শক্তি আবারও ষড়যন্ত্র করছে। বাংলার জনগণ এখন এসবে সায় দেবে না। জনগণ এখন উন্নয়ন চায়, উন্নয়নের শিখরে উঠতে চায়। তাই তারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবে।”

কসবা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট রাসেদুল কায়সার জীবন, রুহুল আমীন বকুলসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও  ছাত্রলীগের  নেতারা এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।

দুই আইন

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোগড়া বাইপাস মোড়ে বিআরটিসহ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে গিয়ে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সদ্য পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।

তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। কিন্তু প্রণয়নের চেয়ে আইন প্রয়োগ করাই কঠিন। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের উদ্বেগের বিষয়ে এক প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সংসদের সমাপণীতে এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।

“ডিজিটাল ক্রাইমকে মোকাবেলা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে কারও উদ্বেগ, শঙ্কা বা আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। এতে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না, ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আমরা সেভাবেই আইনটির প্রায়েগিক বাস্তবতায় যাব।”

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার এমকে মো. আরিফুর রহমান ও শরীফুল ইসলাম, বিআরটি প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সানাউল হক, সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) আব্দুস সবুর, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ঢাকা সার্কেল) মো. সবুজ উদ্দিন খান, গাজীপুর সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিন রেজা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।