একানব্বইয়ের মত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ চান মওদুদ

এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে যেভাবে প্রধান দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার গঠন করে নির্বাচন হয়েছিল, সেইভাবে এবারও ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে’ একাদশ সংসদ নির্বাচন চান বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2018, 10:16 AM
Updated : 17 Sept 2018, 10:16 AM

সোমবার ঢাকায় এক প্রতিবাদ সভায় সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “সংবিধানের বাইরে গিয়ে যদি আপনারা নির্বাচনকালীন সরকার করতে রাজি হন, তাহলে আসুন সংবিধানের বাইরে গিয়ে আমরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা করি।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে আসছেন, চলতি বছরের শেষ দিকে ‘সংবিধান মেনে’, অর্থাৎ তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তবে ২০১৩ সালের মত এবারও নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করা হবে।

অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট বর্জন করা বিএনপি এখনও সেই দাবিতে অনড়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, সংবিধান মানুষের জন্য লেখা হয়, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। সুতরাং মানুষের কল্যাণের পথে সংবিধান কখনো বাধা হতে পারে না।

“১৯৯১ সালের নির্বাচন আপনাদের মনে আছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেব প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান হয়েছিলেন। সেটা কী সংবিধানে ছিল? ছিল না। পরে একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।

“এখানেও তাই হবে। আজকে সরকার বলছে যে, নির্বাচনকালীন সরকার হবে। এই ধরনের সরকার বলতে সংবিধানে কিছুই নাই। তার মানে সংবিধানের বাইরে গিয়ে তারা এই সরকার করতে চাচ্ছেন। তাহলে আমরা যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছি- সেটাও তো সংবিধানের বাইরে থেকে করা যায়।”

দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানের রূপ নিলে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন তখনকার রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ। প্রধান দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতৈক্য হয়- বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ হবেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন এবং নির্বাচন দেবেন।

সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তখনকার এরশাদ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ ইস্তফা দেন এবং ওই পদে আসেন তখনকার প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ।

এরশাদ ৬ ডিসেম্বর সাহাবুদ্দিনকে উপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ পড়িয়ে নিজে পদত্যাগ করেন। উপ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ হন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। 

সেই সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি, খালেদা জিয়া প্রথমবারের মত প্রধানমন্ত্রী হন।

এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে ১৯৯৬ সালে তখনবার বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করে। সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন ওই নির্দলীয় সরকারের অধীনেই হয়। এর মধ্যে দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং একটিতে বিএনপি জয়ী হয়। 

২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকে; তখনই এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

২০১১ সালের ১০ মে এক রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ওই বছরই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার।

শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তা ঠেকানোর আন্দোলনে নামে। অন্যদিকে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করে।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা সংবিধানে নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, তবে সংসদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অধীনে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন; যার নাম দেওয়া হয় ‘সর্বদলীয় সরকার’।

ওই মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর নেতাদের নেওয়া হয়। স্বল্প পরিসরের ওই মন্ত্রিসভা সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। বিএনপিকে সেই ‘সর্বদলীয়’ সরকারে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও তারা প্রত্যাখ্যান করে।

দশ বছরের আন্দোলনে সাফল্য না পাওয়া বিএনপি এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুর্নবহালের কথা বলছে না। তার বদলে নাম বদলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ বলেন,“আজকে তারা (আওয়ামী লীগ) বলছেন যে, নির্দলীয় সরকার অসাংবিধানিক। ১৯৯৫-৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তার ধারণা, এটা তার ব্রেইন চাইল্ড।… আজকে তারাই উল্টো কথা বলেছেন।”

জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে এই প্রতিবাদ সভা হয়।

সংগঠনের সভাপতি সাঈদ হাসানের মিন্টুর সভাপতিত্বে এ সভায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বক্তব্য দেন।