শেখ হাসিনার দেওয়া সেই শর্তেই হোক: কামাল

এক যুগ আগে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে শর্ত তুলে ধরেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সেগুলো এখনও প্রযোজ্য বলে মনে করেন গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2018, 03:19 PM
Updated : 13 Sept 2018, 07:24 PM

তিনি বলেছেন, “অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ২৩টা শর্ত দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৭ এ। সে সব শর্ত এখনও প্রযোজ্য। বিরোধী থাকলে এক রকম হবে, আর সরকারি দল হলে এটা থাকবে না, এটা হতে পারে না।”

বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে একথা বলেন কামাল হোসেন, যিনি ওই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে ছিলেন।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রবীণ আইনজীবী কামাল হোসেনকে নিয়ে এই মতবিনিময় সভা আয়োজন করে। সভা পরিচালনা করেন বিএনপির নিয়ন্ত্রণে থাকা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউদ্দিন খোকন।

বছর শেষে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে চায় বিএনপি; সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তও রয়েছে তাদের। আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না বলে মত গণফোরামেরও।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা নির্দলীয় সরকারের দাবি নাকচ করে বলে আসছেন, সংবিধান অনুযায়ী সরকার ও সংসদ রেখেই নির্বাচন হবে।

আওয়ামী লীগের এক সময়ের নেতা ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য কামাল হোসেন বলেন, “সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নাই, এই দাবিটি আমি কোনোদিন করিনি।

“আজ যদি মনে করা হয়, এই সংবিধানের সংশোধনের প্রয়োজন আছে, আরও উন্নত করার দরকার আছে এবং কী কী ভাবে সংশোধন করলে আরও উন্নত হবে, কোথায় কোথায় সংশোধনী করতে হবে, বিনা দ্বিধায় সেগুলো আপনারা তুলে ধরেন।”

“বর্তমানে সংবিধানের সংশোধনী করে তারা (আওয়ামী লীগ) যেটা করেছে, আমরা যে সংবিধান করেছিলাম, সেটাতে এই বিধান (দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন) ছিল না। ছিল যে, সংসদ ভেঙে নির্বাচন হবে। এখন যেহেতু সংশোধনী হয়েছে, এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে,” বলেন তিনি।

রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বিএনপির সভা-সমাবেশের উপর প্রশাসনের বিধি-নিষেধের সমালোচনাও করেন তিনি।

“সভা-সমাবেশের বিষয়ে সংবিধানে যুক্তিসঙ্গতভাবে কিছু বাধা-নিষেধের কথা বলা আছে। পাইকারিভাবে, যেনতেনভাবে মিটিং করতে দিলাম না, এটা তো চ্যালেঞ্জ করা দরকার। আমরা করেছিও।”

কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে ‘আশার আলো’ দেখছেন বলে জানান গণফোরাম সভাপতি।

তিনি বলেন, “আমি ৪৬ বছরে দেখেছি, কেউ ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, কেউ না। এটা আমি বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের ঐকমত্য আছে।”

কারাগারে আদালত ‘অ্যাবসার্ড’

এক আইনজীবীর প্রশ্নে কামাল হোসেন বলেন, “জেলখানায় আদালত এটা স্ববিরোধী কথা। জেলখানা জেলখানাই, আদালত আদালতই। জেলখানায় আদালত কেন হল, কীভাবে হলো, কোন আইনে হল, এই প্রশ্নগুলো আপনারা আনবেন। এটা অস্বাভাবিক।”

কারাবন্দি খালেদা জিয়ার বিচারে কারাগারে আদালত বসিয়েছে সরকার। বিএনপি এর প্রতিবাদ জানালেও ক্ষমতাসীনরা বলছেন, এতে সংবিধানের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

কর্নেল তাহেরের বিচারের প্রসঙ্গ ধরে কামাল হোসেন বলেন, “কর্নেল তাহেরকে যেভাবে তথাকথিত বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হল, সেটা মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। সেই উদাহরণ দিয়ে ৪০-৪৫ বছর পরে বেসামরিক শাসন যখন চলছে, তার মধ্যে জেলখানায় তথাকথিত আদালত অ্যাবসার্ড।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় ‘চির স্মরণীয়’

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় ‘চিরস্মরণীয়’ হয়ে থাকবে ম্তব্য করে কামাল হোসেন বলেন, যারা এর জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে অপমান করার চেষ্টা করেছেন, তারা চির দিনের জন্য ধিকৃত হয়ে থাকবেন।

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন করেছিল আওয়ামী লীগ, তা বাতিল করে দেন বিচারপতি সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। এরপর নানা নাটকীয় ঘটনা শেষে বিদেশে গিয়ে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সিনহা।

 আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করে আসছেন, ওই সময় বিচারপতি সিনহাকে দিয়ে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ ঘটাতে চেয়েছিলেন কামাল হোসেন।

কামাল বলেন, “গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, এস কে সিনহা যে কাজটি (ষোড়শ সংশোধনীর রায়) করে গেছেন, তা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যারা উনাকে অপমান করার চেষ্টা করেছেন, তারা চির দিনের জন্য ধিকৃত হয়ে থাকবেন। উনি (এস কে সিনহা) কী বলেছেন? বলেছেন যদি সংসদ সদস্যরা রেজুলেশন পাস করিয়ে বিচারকদের সরিয়ে দিতে পারে, তাহলে কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে?

“আমি তো মনে করি ক্লাস সেভেনের শিশুকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সে বলবে এটা অসম্ভব। যার বিরুদ্ধে বিচারক রায় দেবে, সে যদি ওকে (বিচারককে) সরিয়ে দিতে পারে এর (বিচারকের) পক্ষে কি সম্ভব নির্ভয়ে রায় দেওয়া?”

বিচারপতি সিনহার সঙ্গে সরকারের আচরণের সমালোচনা করে কামাল হোসেন বলেন, “উনি যদি সংবিধান লঙ্ঘন করে থাকেন, তাহলে সে প্রসিডিউরও আছে। সে প্রসিডিউর ফলো করে ইমপিচ করতে পারত। কিন্তু পুলিশ নিয়ে গেটে তালা দেওয়া, এগুলো একদমই চলে না। এগুলো অসাংবিধানিক কাজ, একদিন না একদিন এসবের বিচার আমরা করে ছাড়ব।”

বি চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক

সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে একসঙ্গে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কামাল হোসেন।

বৃহস্পতিবার রাতে উত্তরায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি‘র সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসায় যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বি চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন বৈঠক করেন।

বৈঠকের পর কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আমরা একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যুক্তফ্রন্টের ৬ দফা ও  জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ৭ দফাকে সমন্বয় করে আমরা আগামী শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করব।”

কর্মসূচি কী হবে- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “সেদিনই জানতে পারবেন।”

বৈঠকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিকল্পধারার মহাসচিব আবদুল মান্নান, গণফোরামের কার্যনির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন উপস্থিত ছিলেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মো. মনসুরও ছিলেন বৈঠকে।

গত ২৮ অগাস্ট যুক্তফ্রন্টের সভাপতি বি চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকে একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন কামাল।