খালেদার অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে কি না, আদেশ ২০ সেপ্টেম্বর

কারাগারে বসানো আদালতে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচার চলবে কি না- সেই সিদ্ধান্ত জানা যাবে ২০ সেপ্টেম্বর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2018, 08:19 AM
Updated : 13 Sept 2018, 01:19 PM

খালেদা জিয়াকে বৃহস্পতিবারও আদালতে হাজির করতে না পারায় ‍দুদকের আইনজীবী ফৌজদারি আইনের ৫৪০ ‘এ’ ধারায় আসামির অনুপস্থিতিতেই আদালতের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আর্জি জানালে বিচারক শুনানি শেষে আদেশের এই দিন ঠিক করে দেন।

আর খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা জানতে কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করার যে আবেদন তার আইনজীবীরা করেছিলেন, সে বিষয়ে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান।

খালেদা জিয়ার পক্ষে আদালতে শুনানি করেন তার দুই আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও সানাউল্লাহ মিয়া। আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্নার পক্ষে অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম এবং মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে আইনজীবী মো. আক্তারুজ্জামান শুনানিতে ছিলেন। 

আর মামলার বাদী ও তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।

এতিমখানা দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে।

‘অসুস্থতার কারণে’ তাকে গত সাত মাসে একবারও আদালতে হাজির করতে না পারায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ করতে সরকারের নির্দেশে আদালত স্থানান্তর করা হয়েছে কারাগারের ভেতরে, যেখানে তিনি আছেন। 

গত ৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ জজ আদালতের এই অস্থায়ী এজলাসে শুনানির প্রথম দিন খালেদা জিয়া নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে বিচারককে বলেছিলেন, তিনি বার বার আদালতে আসতে পারবেন না, বিচারক তাকে ‘যতদিন খুশি’ সাজা দিতে পারেন।   

এরপর বুধবার শুনানির নির্ধারিত দিনে বিচারক আখতারুজ্জামান আদালতে বলেন, “প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়েছে, উনি (খালেদা জিয়া) কোর্টে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। তার মানে, আসতে অনিচ্ছুক।”

এরপর খালেদার অনুপস্থিতিতে এ মামলার বিচারকাজ চলবে কি-না সে বিষয়ে শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন রাখেন বিচারক।

এদিনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০(এ) ধারা অনুযায়ী খালেদার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চালানোর আর্জি জানান দুদকের আইনজীবী কাজল।

৫৪০ (এ) ধারায় যা বলা আছে

ওই ধারার (১) অংশে বলা হয়েছে- দুই বা ততোধিক আসামি আদালতে হাজির থাকলে এই বিধির অধীন অনুসন্ধান বা বিচারের যে কোনো পর্যায়ে জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট যদি কোনো কারণবশত সন্তুষ্ট হন যে, আসামিদের এক বা একাধিক আদালতে হাজির থাকতে অসমর্থ, তাহলে ওই কারণ লিপিবদ্ধ করে আসামির কৌঁসুলি হাজির থাকলে আসামিকে হাজিরা হতে রেহাই দিতে এবং তার অনুপস্থিতিতে অনুসন্ধান বা বিচার চালিয়ে যেতে পারবেন এবং কার্যধারার পরবর্তী পর্যায়ে ওই আসামিকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির থাকতে নির্দেশ দিতে পারবেন।

(২) অংশে বলা হয়েছে, এইরূপ কোনো মামলায় আসামির কৌঁসুলি না থাকলে, অথবা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামির হাজিরা প্রয়োজন মনে করেন, তা হলে তিনি উপযুক্ত মনে করলে অনুসন্ধান বা বিচার মুলতবি রাখতে পারবেন, অথবা উক্ত আসামির মামলার পৃথকভাবে গ্রহণ করার বা বিচারের আদেশ দিতে পারবেন।

বেলা পৌনে ১২টার দিকে আদালত শুরুর পর আইনজীবী কাজল তার সূচনা বক্তব্যে আইনগত ব্যাখার সঙ্গে অন্য দুই আসামির পক্ষে যুক্তিতর্ক চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন আদালতকে।

তখন খালেদার আইনজীবীরা তাদের আইনগত ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে কারাগারে বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আদালতের কাছে একটি আবেদন করেন।

সানাউল্লাহ মিয়া আদালতে বলেন, “কারা কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিনি আসতে পারবেন না, অনিচ্ছুক। কিন্তু তিনি অনিচ্ছুক কী কারণে, বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে এটা কি-না তা আমরা জানি না। আমরা আপনার আদেশ অনুযায়ী আইনসঙ্গত ব্যাখ্যা দেব, তার আগে আপনার অনুমতি সাপেক্ষে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

আগের দিন আদালতের আদেশের প্রসঙ্গ টেনে খালেদার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, “জেল কর্তৃপক্ষ লিখেছে- তিনি (খালেদা) অনিচ্ছুক। এটা অনেক কঠোর কথা। আপনি নিজেই দেখেছেন। আসলে তিনি ফিজিক্যালি ফিট না, সেজন্য আসেন নাই। তিনি হয়ত বলতে চাইছেন, শারীরিক উপযুক্ততা নাই, সেজন্য আসতে পারছেন না। এর কারণ এই না যে, আমরা বিচার চাই না।”

এই আইনজীবী বলেন, “ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে ছাড়া এ শুনানি চলতে পারে না। সে কারণে উনার সমস্যাটা বোঝার জন্য আপনি আমাদের সাক্ষাতের সুযোগ দিতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিন।”

বিচার না চালানোর কথা আইনজীবীরা বলেননি মন্তব্য করে মাসুদ বলেন, “আদালতের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা কথা বলেছি। কারণ সংরক্ষিত এলাকায় আদালত করা যায় না। আর উনি (খালেদা) আদালত অবজ্ঞার কারণে এখানে আসেননি তা নয়। শারীরিক অসুস্থতা তার না আসার কারণ।”

এ অবস্থায় সরকার গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসা এবং আইনজীবীদের দেখা করা পর্যন্ত আদালত মূলতবি করার আর্জি জানান খালেদার আইনজীবী।

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিচারের ব্যবস্থা হয়েছে কারাগারের ভেতরেই

এরপর আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী আক্তারুজ্জামান খালেদার অনুপস্থিতিতে ‘কেন বিচারকাজ চলতে পারে না’- সে বিষয়ে নিজের যুক্তি উপস্থাপন করেন।

আর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, “একই মামলায় যখন যৌথ আসামিদের বিচার হয়, তখন আইন অনুযায়ী সকল ইস্যুতে তাদের সবার উপস্থিতি থাকতে হয়। এখানে একজন আসামি উপস্থিত নাই, কিন্তু তিনি তো কাস্টডিতে আছেন।”

খালেদা জিয়া আদালতে না আসায় ‘কোরাম নন-জুডিস’ হয়ে গেছে- এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এ মামলার বিচার কাজ চলতে পারে না।

আমিনুল ইসলাম বলেন, “গত দিন আমরা দুটি দরখাস্ত দিয়েছি। বিচারক আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আমাদের আবেদন নাই। আমরা বলেছি, আগের আদালত উন্মুক্ত ছিল, এখন উন্মুক্ত নয়। আর এই আদালত সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে আদালত স্থানান্তরের কথা থাকলেও সেটা করা হয়নি। সে কারণে প্রধান বিচারপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের আইনীজীবীদের একটি আবেদন করা হয়েছে। তার দিক থেকে একটি আইনি ব্যাখ্যা আসবে। সেজন্য অপেক্ষার কথা বলেছি আমরা।”

খালেদার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চলবে কি-না সে বিষয়ে কোনো যুক্তি উপস্থাপন তার আইনজীবীরা না করায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কাজল বলেন, এই অবস্থায় আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার কাজ চলবে কি-না সেটা নিয়ে যুক্তিতর্ক শোনা দরকার।

“তারা আদালতে এসে জামিন নিতে পারেন, জামিন বর্ধিত করতে পারেন, কিন্তু যুক্তিতর্ক করেন না।… কোরাম কোরাম বলছেন। আমরা কি এখানে স্টক এক্সচেঞ্জের মিটিংয়ে বসছি নাকি! উনি যদি না আসেন, ওনার অনুপস্থিতিতেও বিচারকাজ চলতে পারে।”

৫৪০(এ) ধারার প্রসঙ্গে টেনে দুদকের আইনজীবী বলেন, “এখানে দুই ধরনের আসামি আছেন। দুইজন উপস্থিত আর একজন কারাগার থেকে আসছেন না। যারা উপস্থিত আছেন, তাদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক দিক।

“খালেদা জিয়া যেহেতু আসছেন না, সেহেতু তাকে ডিসপেন্স করে দেন। আর আইনজীবীরা তাকে রিপ্রেজেন্ট করবেন। অন্যরা যদি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন না করেন, তাও বলে দিক। আর আইনজীবীরা তাকে রিপ্রেজেন্ট না করলে এবং এদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন না করা হলে সেটাও বলে দিক। তাহলে আপনি মামলার পরবর্তী তারিখ রায়ের জন্য নির্ধারণ করে দিন।”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ৫৪০(এ) ধারার ব্যাখ্যা ‘নিজের মত’ দিয়েছেন মন্তব্য করে খালেদার আইনজীবী মাসুদ তালুকদার বলেন, “কেউ যখন কাস্টডিতে থাকে তখন তাকে ডিসপেন্স করার সুযোগ নাই। বাইরে থাকা অবস্থায় জামিনে থাকলে তাকে ডিসপেন্স করা যায়। এখানে খালেদা জিয়ার না আসার কারণ তার শারীরিক অসুস্থতা। তার সুস্থতার জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় ধার্য করে দিন।

আদালতে খালেদা জিয়াকে ‘রিপ্রেজেন্ট’ নয় ‘ডিফেন্ড’ করা হচ্ছে মন্তব্য করে তার এই আইনজীবী বিচারকের উদ্দেশে বলেন, “উনার কাস্টোডিয়ান এখন আপনি। আপনার কাস্টোডির মধ্যে আমরা সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছি। বিচারকাজে অসহযোগিতা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।”

এই পর্যায়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবী আমিনুল ইসলাম আদালতে বলেন, “৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে এ মামলার কার্যক্রম চলেনি। বেগম জিয়ার অসুস্থতার কারণে কয়েকবার সময় পেছানো হয়েছিল। ওই সময়ে প্রত্যেকবার প্রসিকিউশনের আইনজীবী নিজেই বলেছেন, কাউকে অনুপস্থিত রেখে বিচারকাজ চালানো সম্ভব না। এখন আবার বলছেন, তাকে অনুপস্থিত রেখেই বিচারকাজ চালানো যাবে।”

নিজের আসামির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা টাইম পিটিশন দিইনি। আমরা যুক্তিতর্কের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু এই অবস্থায় (কোরাম নন-জুডিস) প্রসিডিংস চললে সেটা হবে বেআইনি।

“আসামি যদি আদালতে এসে বলেন, তিনি থাকবেন না, আইনজীবী প্রতিনিধিত্ব করবেন, তখন আদালত তা বিবেচনা করতে পারত। কিন্তু তিনি তো বলেননি। আর প্রসিডিংস শোনাতো ওনার মৌলিক আইনি অধিকার।”

সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “উনি আদালত শুনতে চান। আমরা সময় চেয়েছি সেজন্য। কেন তিনি অনিচ্ছুক হয়েছেন, তার শারীরিক অবস্থা কি, আমরা তার সঙ্গে দেখা করে দেখতে-শুনতে চাই।”

তখন বিচারক আখতারুজ্জামান বলেন, “আজকে কারা কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উনাকে ‘বিজ্ঞ আদালতে আসতে বলা হলে উনি বলেছেন, আসতে পারবেন না। অনিচ্ছুক।’ উনি যদি এভাবে অনিচ্ছুক হন, সেজন্যতো অন্যদের বিচারকাজ আমরা বারবার পেছাতে পারি না।”

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি কাজল তখন বলেন, “কাস্টডিতে যদি উনি অসুস্থ থাকেন, তাহলে উনি রেস্টে থাকুন। এভাবে করতে করতে উনি মামলার ১৫টি তারিখের একটিতে উপস্থিত ছিলেন, সেদিন আইনজীবীরা ছিলেন না। তার জন্য আমরা উপস্থিত যারা তাদের কার্যক্রম চালাতে পারছি না।

“উনি না আসলেও বিচারকাজ চলবে। সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে যেভাবে ক্যাসেট বাজিয়ে শোনানো হত, প্রয়োজনে উনার কারাকক্ষে টেলিভিশনে প্রসিডিংস দেখানো হবে। কারণ উনি আসতে চাচ্ছেন না, অসহযোগিতা করছেন।”

কাজল বলেন, “জেলে আসামি থাকলে তাকে ফোর্স করে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার মর্যাদার কথা বিবেচনা করে, উনি একজন নারী হওয়ায় এবং তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সেটা করা হচ্ছে না। এর বিপরীতে তিনি ও তার আইনজীবীরা আদালতকে অসহযোগিতা করেই যাচ্ছেন।”

এ সময় আবারও খোলেদার শারীরিক অসুস্থতার যুক্তি দেখিয়ে তার আইনজীবী মাসুদ তালুকদার বলেন, “জামিন বর্ধিত করে অন্তত ১০টা দিন সময় দেন, আশা করি অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে।”

এ পর্যায়ে ৫৪০(এ) ধারায় প্রসিকিউশনের আবেদনের উপর আদেশ দিতে ২০ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক রাখেন বিচারক।

আর খালেদার সঙ্গে আইনজীবীদের দেখা করার বিষয়ে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বেলা দেড়টার দিকে এজলাস ত্যাগ করেন বিচারক আখতারুজ্জামান।

পুরনো খবর