খালেদার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে কি না, জানতে চান বিচারক

কারাবন্দি খালেদা জিয়া কারাগারের ভেতরে বসানো আদালতে হাজির হতে ‘অনিচ্ছুক হওয়ায়’ তার অনুপস্থিতিতেই জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচার চালিয়ে নেওয়া যায় কি না- তা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের কাছে জানতে চেয়েছেন বিচারক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2018, 08:23 AM
Updated : 12 Sept 2018, 01:15 PM

খালেদা জিয়াকে বুধবার আদালতে হাজির করতে না পারায় ‍দুদকের আইনজীবী ‘দ্রুত বিচারের স্বার্থে’ আসামির অনুপস্থিতিতেই আদালতের কার্যক্রম শুরুর আর্জি জানালে বিচারক এই প্রশ্ন রাখেন।

এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীর বক্তব্য শোনার জন্য বৃহস্পতিবার দিন রেখেছেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান।

অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া এভাবে কারাগারের ভেতরে একজন বন্দির বিচারের ব্যবস্থা করা ‘সংবিধান ও আইন পরিপন্থি’।

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনেরও আবেদন করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।

এতিমখানা দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে।

‘অসুস্থতার কারণে’ তাকে গত সাত মাসে একবারও আদালতে হাজির করতে না পারায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ করতে সরকারের নির্দেশে আদালত স্থানান্তর করা হয়েছে কারাগারের ভেতরে, যেখানে তিনি আছেন। 

গত ৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ জজ আদালতের এই অস্থায়ী এজলাসে শুনানির প্রথম দিন খালেদা জিয়া নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে বিচারককে বলেছিলেন, তিনি বার বার আদালতে আসতে পারবেন না, বিচারক তাকে ‘যতদিন খুশি’ সাজা দিতে পারেন।   

কারাগারের ভেতরে অস্থায়ী আদালত স্থানান্তর নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই বুধবার দ্বিতীয় দিনের মত এ আদালতের কার্যক্রম চলে। সকাল ১০টায় বিচারকাজ শুরুর কথা থাকলেও আদালতের কার্যক্রম শুরু হতে বেলা ১২টা ২০ বেজে যায়।

শুরুতে আদালতের অবস্থা নিয়ে খালেদার পিটিশন এবং জামিন আবেদন নিয়ে বক্তব্য দেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া।

আদালত স্থানান্তর নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনেই এটাকে ‘কারাগার’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এতো ছোট আদালত… আমরা চারজন এলেও বসতে পারছি না। সাংবাদিকসহ অন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ডিফেন্সের সবাই এলে এখানে এতো সাফোকেশন হবে, বিচারকাজ চালানো সম্ভব না।”

সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “এই অবস্থায় এখানে বিচারকাজ চলতে পারে কি-না, এটা সংবিধান পরিপন্থি কি-না- সে বিষয় আমরা পিটিশনে উল্লেখ করেছি।”

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিচারের ব্যবস্থা হয়েছে কারাগারের ভেতরেই

এই আদালত বসানো নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষাৎ এবং খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠকের কথাও তুলে ধরেন এই আইনজীবী।  

“বেগম জিয়ার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আর এই আদালত করার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করা হয়নি। এ অবস্থায় কারাগারের ভেতরে আদালত বসানো যায় কি-না… এখন যেহেতু তার কাছে আইনজীবীরা গিয়েছেন, তিনি একটি সিদ্ধান্ত দেবেন।”

সাধারণত আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বিচারকের নাম থাকলেও এবারের প্রজ্ঞাপনে তা ছিল না কেন, সেই প্রশ্ন তোলেন সানাউল্লাহ মিয়া।

এরপর জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম একটি পিটিশন পড়ে শোনান। এই আদালত ‘আইনসম্মত’ হয়নি দাবি করে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করার আবেদন জানানো হয়েছে সেখানে। 

আইনজীবী আমিনুল বলছেন, কারাগারের ভেতরে এভাবে আদালত বসানো সংবিধানের ৩৫(৩) ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫২ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

“বেআইনিভাবে গঠিত অত্র আদালত ও বিচারিক কার্যক্রম স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় বরাবর একটি আবেদন পেশ করা হয়েছে। এই রূপ অবস্থায় আইনসম্মত আদালত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত অত্র মামলার কার্যক্রম ন্যায়বিচারের স্বার্থে স্থগিত হওয়া আবশ্যক।”

আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, “আদালত কক্ষটি আনুমানিক ১২ ফুট বাই ২৪ ফুট আয়তনের। এই ছোট্ট কক্ষে বিচারকের আসন, আইনজীবীদের বসার স্থান, পাবলিক প্রসিকিউটর, সাক্ষী ও বিচারপ্রার্থীদের বসার স্থানসহ আদালতের স্টাফ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী- সকলের একত্রে অবস্থান এবং বিচার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ মোটেই সম্ভবপর নয়।”

এ আদালতকে গুহার সঙ্গে তুলনা করে গরম ও শ্বাসকষ্টে যে কেউ যে কোনো সময় ‘মারা যেতে পারে’ বলেও মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।

আমিনুল ইসলাম বলেন, গেজেটে বলা হয়েছে নিরাপত্তাজনিত কারণে কারাগার স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু বকশীবাজারের আদালত থেকে যতবারই সময় পেছানো হয়েছে, ততবারই খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে সেটা করা হয়েছিল। নিরাপত্তার বিষয়টি তখন একবারও ওঠেনি; প্রসিকিউশন থেকেও বলা হয়নি।

“কারাগারে থাকা আসামিকে আদালতে হাজির করার দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষ ও প্রসিকিউশনের। কিন্তু এখানে বেগম জিয়া উপস্থিত নাই। তিনি অনুপস্থিত থাকা অবস্থায় কোরাম নন-জুডিস হওয়া সত্ত্বেও বিচার কার্যক্রম চলছে। প্রসিকিউশন সেটা বলার কথা থাকলেও, তারা কিছু বলছে না।”

এরপর রাষ্ট্রপক্ষে দেওয়া বক্তব্যে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আইন মেনে এ আদালত গঠিত হয়েছে। এখানে আদালত বসেছে খালেদা জিয়ার ‘সুবিধার জন্য’ ।

“বেগম খালেদা জিয়া ও অন্য আসামিদের আইনজীবীরা এই আদালতকে সংবিধান পরিপন্থি, আইন পরিপন্থি ও অবৈধ বলছেন। আবার তারাই সেখানে দাঁড়িয়ে জামিন আবেদন করছেন। এই আদালত যে কোনো আইনে বৈধ। বৈধ আদালতে দাঁড়িয়ে তারা জামিনের জন্য শুনানি করছেন। কিন্তু বৈধ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন না।”

আদালতের গঠন নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্যকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ আখ্যায়িত করেন তিনি।

কাজল বলেন, “আদালত গঠনের ক্ষেত্রে পাবলিক হওয়ার পাশাপাশি দ্রুত বিচারের কথাও আছে। তারা দ্রুত বিচারের বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না। দ্রুত বিচারের স্বার্থে এখন যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই আদালতের কার্যক্রম শুরু হোক।”

পরে বিচারক আখতারুজ্জামান আদালতে খালেদার হাজির না হওয়া প্রসঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া চিঠির কথা জানান।

তিনি বলেন, “প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়েছে, উনি (খালেদা জিয়া) কোর্টে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। তার মানে, আসতে অনিচ্ছুক।”

এরপর বিচারক খালেদার আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, তার মক্কেল যদি না আসেন, তাহলে জামিন শুনানি কীভাবে হবে এবং এভাবে আসতে অনিচ্ছুক হলে ‘কোরাম নন-জুডিস’ রেখে বিচারকাজ চালানো যাবে কি-না।

জবাবে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, খালেদা জিয়া যেহেতু কারাগারে আছেন আর আদালত কারাগারের ভেতরে, তাহলে দুটোই থাকছে ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে’।

“সে কারণে উনি কেন আসতে পারেননি, কী বলেছেন সেটা আমরা এখনও নিশ্চিত না। আবার উনি যেহেতু আগের দিন বলেছেন অনেক বেশি অসুস্থ, উনার শারীরিক অবস্থা এখন কী, সেটাও তার সাথে দেখা করা ছাড়া বলা সম্ভব না।”

আর কারাগারে থাকা আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার কাজ চলতে পারে কিনা- সে বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা দিতে পড়াশোনা করার সময় প্রয়োজন বলে আদালতের কাছে আবেদন জানান সানাউল্লাহ মিয়া।

খালেদার আইনজীবীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কাজল বলেন, “বারবার বলা হচ্ছে খালেদা জিয়া অসুস্থ। তারাতো (খালেদার আইনজীবীরা) ওইদিন ছিলেন না। উনি (খালেদা)  কিসের অসুস্থ। হুইল চেয়ারে তাকে আনা হয়েছে। উনি আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সবাই দেখেছে।”

খালেদা জিয়া অনুপস্থিত থাকলেও বিচারকাজ তার ‘আইনি গতিতে’ চলতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

উভয়পক্ষের বক্তব্যের পর খালেদার অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চলবে কি-না এবং এই অবস্থায় জামিন শুনানি হবে কি-না সে বিষয়ে শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন রাখেন বিচারক।

আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “আদালত প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি কাস্টডিতে আছেন, কিন্তু আসতে ইচ্ছুক নন। খালেদা জিয়ার প্রকৃত তথ্য হল, তিনি গুরুতর অসুস্থ। এ কারণে তিনি আসেন নাই।”

তিনি বলেন, “আদালত ভবন এবং জেলখানা একই জায়গায়, দুইটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কারা কর্তৃপক্ষের কী দুটো মাথা আছে? আদালতের কী দুটো মাথা আছে, যে অন্য কিছু লিখে দেবে?”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কাজল বলেন, “কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় আসামিকে হাজির করার দায়িত্ব হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষের। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে হাজির করবে, আদালত তার বিচার করবে। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়া যদি না আসেন, তিনি যদি অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, সেক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিটাকে উপস্থিতি ধরে নিয়ে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করব।

“আদালত বলেছেন, ‘আপনারা একদিকে জামিন চাচ্ছেন, আবার জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বলছেন, আবার আপনারা সেখানে আসছেন না, সেক্ষেত্রে কীভাবে জামিন বর্ধিত করা হবে সে ব্যাপারে আইনগত ব্যাখ্যা দেন।’ উনারা আইনগত ব্যাখ্যা কালকে দেবেন।”

আদালত ঘিরে এদিনও নাজিমউদ্দিন রোড এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আদালতকক্ষেও পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি দেখা যায়। আসামিপক্ষের পাঁচ আইনজীবীর সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষে আট জন আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

পুরনো খবর