কারাগারের আদালতে যেমন দেখা গেল খালেদাকে

পরনে ছিল সেই ট্রেডমার্ক গোলাপী শাড়ি, পায়ে সাদা জুতা; কিন্তু কারাগারের ভেতরে বিশেষ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে হুইল চেয়ারে বসা বিএনপিনেত্রীর চোখেমুখে হতাশা আর বিষণ্নতা ছিল স্পষ্ট।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2018, 02:27 PM
Updated : 5 Sept 2018, 05:30 PM

‘অসুস্থতার কারণে’ খালেদা জিয়াকে গত সাত মাসে একবারও আদালতে হাজির করা যায়নি। এ কারণ জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ করতে এই বিশেষ এজলাসের ব্যবস্থা করেছে সরকার।

সেই এজলাসে বিচার কার্যক্রমের প্রথম দিন বুধবার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কেউ আদালতে আসেননি। আর খালেদা জিয়ার কণ্ঠে ছিল বিচার কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ, অবিশ্বাস।

এই আদালত বসেছে সেই কারাগারে, যেখানে এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজার রায় নিয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বন্দি আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। পরিত্যক্ত এই কারাগারে তিনিই একমাত্র বন্দি।    

কারাগারের ভেতরে এক সময় যে ভবনটি ডে কেয়ার সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হত, তার দোতলার একটি ঘর এখন খালেদার কারাকক্ষ। সেই কক্ষ থেকে দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে তাকে নিয়ে আসা হয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় বসানো বিশেষ আদালতের এজলাসে। 

পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকতেই নিচতলায় হাতের ডান দিকের ৭ নম্বর কক্ষে সাজানো হয়েছে এই অস্থায়ী আদালতের এজলাস। সেদিকে ঢোকার পথে ডান পাশের ৬ নম্বর কক্ষকে বানানো হয়েছে বিচারকের খাস কামরা।

কারাগারের এই ভবনের নিচতলায় বসেছে বিশেষ আদালতের অস্থায়ী এজলাস

কারাগারের ভেতর থেকে খালেদার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে আসেন একজন নারী কারারক্ষী। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢাকা ছিল সাদা চাদরে। কিছুক্ষণ পর আদালত কক্ষে আসেন কারাগারে তার সঙ্গী ব্যক্তিগত গৃহকর্মী ফাতেমা।

লাল কাপড়ে মোড়া এজলাসের সামনে বিচারকের ডান দিকে সাক্ষীদের কাঠগড়া। তার ঠিক পরে প্রসিকিউশনের তিনজন আইনজীবী বসার জায়গা।

এজলাসের ঠিক সামনে পেশকারের বসার স্থান রাখা হয়েছে এ আদালতে। আর আসামিপক্ষের আইনজীবী ও অন্যদের জন্য তিনটি টেবিল ও চেয়ার রাখা হয়েছে বিচারকের মুখোমুখি করে।

বিচারকের বাঁ দিকে আসামিদের কাঠগড়ার সামনে খালেদা জিয়া যেখানে হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন, তার সামনে ছিল সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটি টি টেবিল। সেখানে ছিল টিশু আর পানি।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা না থাকায় এদিন যুক্তিতর্কের শুনানি শুরু করতে পারেননি বিচারক। আদালতের কার্যক্রম চলে সব মিলিয়ে আধা ঘণ্টার কম।  

এর মধ্যে কযেকবার টিশু নিয়ে মুখ মুছতে দেখা যায় খালেদাকে। আইনজীবীরা যখন কথা বলছিলেন, বেশিরভাগ সময় তাকে ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়।

খালেদার আইনজীবীরা না এলেও বিএনপিপন্থি আইনজীবী ঢাকা বারের সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান এদিন আদালতে এসেছিলেন পর্যবেক্ষক হিসেবে। আদালত কক্ষে আসার পরপরই তার সঙ্গে কথা বলেন খালেদা জিয়া।

অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু, শাহ আলম তালুকদার ও তাপস কুমার পাল আদালতে ছিলেন সকাল থেকেই।

কারাগারে যাওয়ার পর গত এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিএসএমএমইউতে নেওয়া হলে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল খালেদা জিয়াকে; এরপর তাকে আর এভাবে দেখা যায়নি

সোয়া ১২টায় বিচারক এজলাসে ওঠার পর শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের সূচনা বক্তব্যের পর কথা বলেন ঢাকা বারের সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান।

বিচারকের সঙ্গে তার আলোচনার এক পর্যায়ে কথা বলতে চান খালেদা জিয়া। তার কথা শুনতে এগিয়ে যান কাজল ও গোলাম মোস্তফা।

আদালতের উদ্দেশে কথা বলার সময় খালেদা বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান।

তিনি বলেন, “আমার আইনজীবীদের কেউতো এখানে নাই। আমার শারীরিক অবস্থাও ভালো না। ডাক্তার বলেছে, এভাবে বসে থেকে বেশিক্ষণ পা ঝুলিয়ে রাখলে ফুলে যেতে পারে। হাতেও প্রচণ্ড ব্যথা। এ অবস্থায় আদালত চলতে পারে না।”

বিচারকের উদ্দেশে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনার যতদিন ইচ্ছা সাজা দিন, আমি এ অবস্থায় বারবার আসতে পারব না।”

এরপর বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সাজাইতো হবে, ন্যায়বিচার নাই এখানে।”

বেলা ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে আদালত থেকে কারাকক্ষে ফিরে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সামনেও কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন

তিনি বলেন, “এখানে আদালত হওয়ার সিদ্ধান্ত হল সাতদিন আগে, গেজেট জারি কালকে করা হল কেন? আদালত বসল, আমার সিনিয়র আইনজীবীরা জানে না। তাহলে আদালত চলে কীভাবে?”

নিজের শারীরিক অবস্থা ভালো নয় জানিয়ে ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ বলেন, “আমার বাঁ পা ঠিকমত রাখতে পারি না, প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার মত। বাঁ হাতেও অনেক ব্যথা।”