আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইভিএমে বিরোধিতার কারণ জানতে চাওয়ার প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্য-উপাত্তসহ নিজেদের যুক্তি তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, “ইভিএমের মাধ্যমে যে ভোট ডাকাতি করা যায়, তা আজ বিশ্ব স্বীকৃত। নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বল্প পরিসরে যে ইভিএম ব্যবহার করেছে তাতেও কোনো জায়গায় বিশেষ করে বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর ও খুলনায় ইভিএম কখনও কখনও বন্ধ হয়ে গেছে। একজনের ভোট আরেকজন দিয়েছে। কোথাও ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালট পেপারেও ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করতে হয়েছে।”
এই যন্ত্রে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়া ‘সম্ভব’ দাবি করে ফখরুল বলেন, ‘‘ইভিএম সহজেই ম্যানিপুলেট করা যায়। ভোটার ছাড়াও চাইলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার তার নিজের বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে ইভিএমকে ভোটদানের উপযোগী করতে পারে। ফলে অসাধু সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের মাধ্যমে যে কোনো প্রার্থীর পক্ষে সকল ভোট সহজেই কাস্ট করা সম্ভব। পোল কার্ডের মাধ্যমে ভোটের ফলাফল সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়া সম্ভব।”
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন ইভিএমে ভোটগ্রহণ হচ্ছে- ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পাল্টায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, “পৃথিবীর ৯০ ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে ই-ভোটিং, ইভিএম, ডিভিএম পদ্ধতি চালু নেই।
“হাতেগোনা যে কয়টি দেশ এই পদ্ধতি চালু করেছিল, প্রচণ্ড সন্দেহ ও বিতর্কের পর তারা এটি থেকে সরে এসেছে। জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ইত্যাদি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ এই পদ্ধতি ইতোমধ্যে পরিত্যাগ করেছে।”
সংবাদ সম্মেলনে স্কাইপে যুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সিকিউরিটি এক্সপার্ট ম্যাট বিশপ ইভিএমের ত্রুটি-বিচ্যুতির নানা দিক ব্যাখ্যা করে বলেন, “বাংলাদেশ ইভিএমের জন্য প্রস্তুত নয়।”
ফখরুল বলেন, ‘‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে আবার হুঁশিয়ার করছি, অবিলম্বে ইভিএম, ডিভিএম ক্রয়ের উদ্যোগ পরিত্যাগ করুন। আপনাদের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতাকে আর ঘনীভূত করবেন না।
“ডিজিটাল কারচুপির পথ থেকে সরে আসুন। অন্যথায় ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে এই অপতৎপরতার জন্য মূল্য দিতে হবে।”
আওয়ামী লীগ এখন জনগণের উপর আস্থা হারিয়ে মেশিনের উপর ভর করেছে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।
গত কিছুদিন ধরে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের তোড়জোড় শুরু হয়। এছাড়া দেড় লাখ ইভিএম কিনতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও ইসি তৈরি করেন।
ইতোমধ্যে তিনশ আসনের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অর্থ্যাৎ একশটি আসনে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগের কথাও জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
একাদশ নির্বাচনে ইসি যদি শেষ পর্যন্ত ইভিএম বাস্তবায়ন করে সেক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা কী হবে- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে ফখরুল বলেন, “ইভিএম কার্যকর করতে পারবে না।
“ইভিএম পদ্ধতির উদ্যোগ দুরভিসন্ধিমূলক ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণের ভোটাধিকার হরণ বৈ আর কিছুই না। দেশের জনগণ যে কোনো মূল্যে নির্বাচন কমিশনের এই অপতৎপরতা অবশ্যই প্রতিহত করবে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, জাতীয় ঐকমত্য এবং সার্বজনীন আস্থা সৃষ্টি না হলে ইভিএম ব্যবহার করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে না।
“এরপর হঠাৎ কী ঘটল? কী কারণে, কার নির্দেশে, কাকে নির্বাচনে বিজয়ী করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গোপনে তাড়াহুড়া করে এই বিতর্কিত এবং সারা বিশ্বের প্রায় পরিত্যক্ত ইভিএম যন্ত্র কেনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন?”
ইভিএম প্রকল্পের ‘নামে অর্থ লুটের উদ্যোগ’
জনগণের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইভিএম ক্রয় প্রকল্পের নামে ‘অর্থ লোপাটের’ অভিযোগ তুলেছেন ফখরুল।
তিনি বলেন, “সরকারি আর্থিক শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি উপেক্ষা করে অতি দ্রুত ইভিএম প্রকল্প বাস্তবায়নের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। ইসি যেখানে ২০১০ সালে ১০ হাজার টাকা মূল্যে একটি ইভিএম মেশিন ক্রয় করেছিল, সেখানে আজ ২০ গুণ বেশি দামে প্রতিটি ইভিএম মেশিন দুই লাখ পাঁচ হাজার টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। এটা জনগণের অর্থ লোপাটের আরেকটি উদ্যোগ বৈ আর কিছু না। এটি সরকার ও ইসির একটি অশুভ পার্টনারশিপ।”
ইভিএম প্রকল্প বাদ দিয়ে চার হাজার কোটি টাকার অর্থ নির্বাচন সুষ্ঠু করার কাজে ব্যয়ের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানান ফখরুল।
গুম বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান দাবি
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল গত এক দশকে গুমের বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ‘‘আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস। বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে গত এক দশকে বাংলাদেশেও অসংখ্য ব্যক্তি, তরুণ-যুবক রাজনৈতিক কারণে গুম হয়েছে। আমাদের দলের সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী, মো. পারভেজ, সিটি করপোরেশনের কমিশনার চৌধুরী আলম, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যারিস্টার আরমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আযমীসহ এখনও অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ রয়েছে, গুম হয়েছে যাদেরকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ আছে।
‘‘আমরা আজকে এই দিবসে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি তাদেরকে দায়িত্ব হিসেবে গুম ও নিখোঁজ হওয়ার মানুষদের খুঁজে বের করে তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার জন্য।”
গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মাহবুবুর রহমান, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য বিজন কান্তি সরকার,সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার প্রমুখ।