হামলায় জিয়া পরিবার জড়িত ছিল, সন্দেহ নেই: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৪ বছর আগে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচিতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় যে ‘জিয়া পরিবার জড়িত ছিল’, সে বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2018, 06:44 AM
Updated : 21 August 2018, 09:47 AM

‘হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মধ্য দিয়ে উত্থান’ হওয়া বিএনপি কখনো দেশের কল্যাণ করতে পারে না বলেও দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে বিএনপি-জামাত জোট ওই গ্রেনেড হামলা চালায়।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের যে জায়গায় সেদিন ওই হামলা হয়েছিল, সেখানে মঙ্গলবার সকালে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

তিনি বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের যে চেষ্টা; এর সাথে বিএনপি যে একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, খালেদা জিয়া, তার ছেলেরা যে জড়িত তাতে কোনো সন্দেহ নাই।”

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২১ অগাস্ট বিকালে আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত সন্ত্রাস বিরোধী শোভাযাত্রার কর্মসূচি ছিল। শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরপরই তা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু গ্রেনেড হামলায় স্তব্ধ হয়ে যায় সন্ত্রাসবিরোধী সেই কর্মসূচি।

আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে যে ট্রাকটিতে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে সেদিন সমাবেশ পরিচালিত হচ্ছিলো; ওই ট্রাকটিকে লক্ষ্য করে পরপর ১৩টি গ্রেনেড ছোড়া হয়। ওই ট্রাকের ওপরই ছিলেন শেখ হাসিনা। দলীয় নেতারা মানববর্ম তৈরি করে তাকে রক্ষা করেন।

সেদিন বেঁচে গেলেও স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমান বসে ছিলেন ট্রাকে তৈরি মঞ্চের পাশে কর্মীদের সঙ্গে। প্রাণ হারান তিনিসহ ২৪ জন। যারা আহত হন, তাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হন, ঘটে অঙ্গহানি।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে চালানো ওই হামলার লক্ষ্য যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাই ছিলেন, তা পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে। 

সে সময় এই ঘটনার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয় বলে পরে উন্মোচিত হয়, আসামি হিসেবে এখন বিচারের সম্মুখীন ওই সময়ের তদন্ত কর্মকর্তারাও। 

অধিকতর তদন্তের পর এখন এই মামলার আসামির তালিকায় তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে যোগ হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলে তারেক রহমানও। ওই মামলার বিচার শিগগিরই শেষ হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আশা করছেন। 

ওই হামলার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলে। 

সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “প্রকাশ্যে এরকম হামলার ঘটনা ঘটার কোনো দৃষ্টান্ত আমার মনে হয় নেই।… সেদিন হামলাকারীরা যেভাবে এখানে এস হামলা করল, স্বাভাবিকভাবেই সবাই বুঝতে পারল, কারা এর পেছনে রয়েছে।”

খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, “তারা বলেছিলেন, ১৫ অগাস্ট যেভাবে আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে, আমি নাকি সেই একই পথে যাব। খালেদা জিয়া আরেকটা বক্তৃতায় আমার নাম নিয়ে বলেছিলেন, ‘হাসিনা সে প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, বিরোধী দলের নেতাও হতে পারবে না। আওয়ামী লীগ ১০০ বছরেও ক্ষমতায় যেতে পারবে না।’

“এবং তার পরেই কিন্তু ওই হামলা। খুব স্বাভাবিকভাবে যে কোনো মানুষের কাছে এটা উপলব্ধি হবে, আমাকে তো মারবেই মারবে, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, যাতে আওয়ামী লীগ আর শত বছরেও ক্ষমতায় যেতে না পারে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশে এরকম একটি ঘটনা ক্ষমতায় থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটই ঘটিয়েছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওইরকম একটি হামলার পর আলামত সংগ্রহ করার নিয়ম থাকলেও তখনকার সরকার আর পুলিশ লিপ্ত হয়েছিল আলামত নষ্ট করার কাজে। হামলায় আহতদের সাহায্য করতে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাকর্মীরা যখন ছুটে গেলেন, তখন পুলিশ তাদের ওপর টিয়ার শেল ছোড়ে।

“এখানে ডিজিএফআইয়ের এক অফিসার কর্মরত ছিল, সে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ফোন করে জানতে চায়- এটা কি হচ্ছে? এটা কেন হচ্ছে? তাকে ধমক দিয়ে বলা হয়েছিল, তোমার ওখানে কী কাজ? তুমি ওখান থেকে সরো।

“যে সমস্ত পুলিশ কর্মকর্তা সাহায্য করতে চেষ্টা করেছিল, বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে তিরস্কার করা হয়েছিল। তাদেরকে সরে যেতে বলা হয়েছিল।”

ওই হমলায় নিহতদের স্মরণে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী।

পরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে সাধারণত যেখানে সমাবেশের দিন ট্রাক রাখা হয়, সেখান থেকে ট্রাকটি সেদিন সামান্য সামনে ছিল বলে তিনি গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।

“আমার এটা মনে হয়, আল্লাহর কোনো একটা ইশারা ছিল। নইলে আমরা যেখানে ট্রাক দাঁড়া করাই সেখানে যদি থাকত, তাহলে কিন্তু ওই গ্রেনেডটা আমাদের ট্রাকের ভেতরে এসে পড়ত।”

তিনি অভিযোগ করেন, নিয়মমাফিকভাবে র‌্যালি-সমাবেশের আগে বিভিন্ন ভবনের ছাদে আওয়ামী লীগের ভলান্টিয়াররা নিয়োজিত থাকলেও সেদিন তাদের কাউকে ছাদে উঠতে দেওয়া হয়নি।

বিএনপি সরকার শুরুতে ওই সমাবেশের অনুমতি না দিলেও পরে ২০ অগাস্ট রাত সাড়ে ১১টায় সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছিল জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “জানতাম না, এর পেছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে।”

এরকম একটি হামলা যে হতে পারে, ১৫ অগাস্ট সে আভাস পেয়েছিলেন বলেও জানান তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা।

“আমার কাছে ছোট্ট একটা চিরকুট আসে। ধানমন্ডির ৫ নম্বরে তারেক জিয়ার যে খালা শ্বাশুড়ির বাড়ি, তারেক জিয়া তখন সেখানে থাকে। এর আগে ৯ মাস ছিল। পরে পহেলা অগাস্ট আবার চলে এসে। পনের অগাস্ট গভীর রাতে গাড়ি এসে বড় বড় পেটি নামায়, বোরকা পরা লোক এসে জিপে করে পেটি নিয়ে চলে যায়।

“কাজী জাফরউল্লাহ সাহেব তখন ছিলেন। তাকে বললাম, ওই বাড়িতে কী হচ্ছে খবর নেন। তিনি বললেন, পরদিন র‌্যালি আছে, পরে খবর নেবেন। তারপরই তো ওই হামলা।”

২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলারর প্রকৃত খুনিদের আড়াল করে বিএনপি সরকার ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকে ‘অন্য দিকে ঘুরাতে’ চেষ্টা করেছিল বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

“গুজব ছড়ানো বা মিথ্যা কথা বলায় বিএনপির চেয়ে পারদর্শী আর কেউ নাই। তারা সব দিকে ছড়াল, স্কুলের বাচ্চাদের কাছে বলল, আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে এসে মেরেছি। মানে আমি নিজে নিজে আত্মহত্যা করতে এসেছি!”

ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে একুশে অগাস্টে হতাহতদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বিএনপির সরকার বাধা দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা।

“চিকিৎসায় বাধা দিয়েছিল তারা। বিএনপি সমর্থক ডাক্তাররা হাসপাতালে ছিল না। তখনকার পিজিতে আহতরা ঢুকতেই পারে নাই।”

আহত আওয়ামী লীগ নেতাদের সেদিন সংসদেও কথা বলতে দেওয়া হয়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে হাসি তামাশা, ঠাট্টা করেছে। তারা এ নিয়ে পার্লামেন্টে বক্তব্য দিতে দেয়নি। মাইক বন্ধ করে দিত, ব্যঙ্গোক্তি করেছিল।”

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দোষীদের বিচার না করে বিএনপি সরকার তাদের পদোন্নতি দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করেছিল বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। 

তিনি বলেন, “তাদের দুঃখ ছিল, আমি কেন মরলাম না । খবর নেওয়ার চেষ্টা করছিল। জানি না তাদের কি ইচ্ছা। বাংলাদেশের মাটিতে ফেরার পর থেকেই যত বার যেখানে গিয়েছি, ততবারই এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আল্লাহ আমাকে প্রতিবার বাঁচিয়েছে।”

শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ‘১৯টি ক্যু’র মাধ্যমে বাংলাদেশ এক ‘রক্তাক্ত জনপদে’ পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য’। আওয়ামী লীগ সরকারে এসে তা বন্ধ করতে চেষ্টা করেছে।

দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, “যারা জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে, আগুন দিয়ে মানুষ মারতে পারে, নারী ও শিশু হত্যা করতে পারে; যারা প্রকাশ্য দিবালোকে বিরোধী দলের র‌্যালিতে গ্রেনেড হামলা করতে পারে, তারা কখনো কোনো দেশের কল্যাণ ও মঙ্গল করতে পারে না।… এরা কেবল রক্ত নিতে জানে।”

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোটের কেউ যাতে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “বিএনপি-জামাত জোটের যারা ঘাপটি মেরে থাকে, তারা অনেকে আমাদের দলের সাথে মিশে যায়। দলে ঢুকে আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা করে আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপায়। এদের যেন কেউ দলে না টানে।”

শেখ হাসিনা বলেন, তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন দেশকে উন্নত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন।

‘আত্মত্যাগের আদর্শে মহিমান্বিত’ ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি সব রকমের সুযোগ করে দিতে, যেন ঈদের খুশি প্রত্যেকের ঘরে ঘরে আসে।”