বাংলাদেশে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিরা শক্তিশালী হয়েছে: আলী রিয়াজ

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ‘সংস্কারবাদী ইসলামপন্থি’ রাজনীতি দুর্বল হয়েছে, বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে ‘রক্ষণশীল’ ইসলামপন্থিরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2018, 04:22 PM
Updated : 6 July 2018, 06:17 PM

প্রবাসী এই অধ্যাপকের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান ‘রাজনৈতিক সংকট’ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন ও ‘গভীরতর’।

এই ধারণার পক্ষে যুক্তি হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীনদের ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ এবং কথিত সুশীল সমাজের ‘চিহ্নহীন’ হয়ে পড়ার কথা বলেছেন তিনি।

শুক্রবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক গণবক্তৃতায় বক্তব্য দেন আলী রীয়াজ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থিদের প্রভাব নিয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল ও সংস্কারপন্থি। গত কয়েক বছরে তুলনামূলকভাবে সংস্কারপন্থি ধারা দুর্বল হয়েছে।

“তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিরা রাজনীতির প্রান্তিক অবস্থান থেকে রাজনীতির কেন্দ্রে আসতে সক্ষম হয়েছে।”

সংস্কারপন্থি ও রক্ষণশীল হিসেবে কোনো দলের নাম বলেননি তিনি। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে চাপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামী।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছেন একাত্তরের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা। বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় ঘোষণার পর কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের সংঘর্ষে জড়ায় জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা।

এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতে জোট শরিক বিএনপির সঙ্গে তারাও মাঠে নেমে ব্যর্থ হয়। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের হারানো জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনও বাতিল হয়েছে আদালতের রায়ে।

অপরদিকে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে মাঠে নামা কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম পরবর্তী সময়েও আলোচনায় এসেছে। তাদের দাবির মুখে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “বর্তমানে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিরা রাজনীতির এজেন্ডা নির্ধারণের মতো ক্ষমতা রাখেন। ক্ষমতাসীন দল গত দুই-তিন বছরে এই শক্তিকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।”

আগামী নির্বাচনে বিএনপি ও অন্যান্য দল অংশ না নিলে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিদের প্রভাব সবচেয়ে বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক আলী রীয়াজ বলেন, “এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা আসলে হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের এক ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়।”

‘সুশীল সমাজ’ নিয়ে এই কলামনিস্ট বলেন, “এক সময় যে প্রাণবন্ত সিভিল সোসাইটি ছিল, আজ তার চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। গত এক দশকে সিভিল সোসাইটির বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রচারণা চালানো হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, নির্বাচনকে জবাবদিহির একমাত্র ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

“যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু আর সব ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়। বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, সহিংসতার ব্যাপক বিস্তারের যে সব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা এখানেই।”

ভারতের ভূমিকা বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “ভারত চারটি কারণে বাংলাদেশে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকার রাখতে চায়। এগুলো হলো-বাংলাদেশে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি, এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলা, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের মিত্রের অভাব এবং ইতোমধ্যে ভারতের যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হয়েছে তা রক্ষা করা।”

আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, “বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অভাব। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি এবং তা ব্যক্তিনির্ভর।

“ফলে এসব প্রতিষ্ঠান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতা, অধিকারহীনতায় ভুগছেন। এ সমস্যার প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান করা জরুরি এবং তা করতে হবে তরুণদের।”