আ. লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নানা কর্মসূচি

নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শনিবার ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2018, 09:46 AM
Updated : 22 June 2018, 09:46 AM

সূর্যোদয়ের ক্ষণে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সারা দেশের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এই কর্মসূচি।

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদের শুক্রবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরেন।

তিনি জানান, শনিবার সকাল ৯টায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। এরপর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।

সেখানে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং পায়রা ও বেলুন ওড়ানো শেষে দলের প্রধান কার্যালয়ের নতুন ভবনের ফলক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে বেলা ১১টায় তিনি দলের নেতাদের নিয়ে বিশেষ বর্ধিত সভায় অংশ নেবেন।

কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে এই বর্ধিত সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, দেশের বিভিন্ন মহানগরের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সারা দেশের জেলা ও উপজেলা, পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা মিলিয়ে মোট ৪১৫৭ জন নেতা উপস্থিত থাকবেন।

আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও পৌরসভায় দল মনোনীত মেয়র ও চেয়রম্যন এবং  দলের সহযোগী সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরাও থাকবেন তাদের মধ্যে।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ৬৯ বছরে সাফল্যের পাশাপাশি অতৃপ্তি আছে কি না জানতে চাইলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “সব সাফল্যের গাথা ভরপুর হয় না, সব কীর্তির কীর্তিগাথা ভরপুর হয় না। জোয়ার ভাটা আছে। আওয়ামী লীগের ইতিহাসেও জোয়ার ভাটা আছে।”

ইতিহাস

ভারত ভাগের দুই বছর পর মুসলিম লীগের প্রগতিশীল একটি অংশের উদ্যোগে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে এ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে; প্রায় দুই যুগ পর এ দলের নেতৃত্বেই স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজগার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।”

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা সেদিন রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।

“আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।”

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার 'মুকুল' প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগেরসম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সংগঠনের ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব।

আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যাত্রা শুরু করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালে কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। নতুন নাম হয়-‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম নেয় দলটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ৫০ এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্বপাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।

তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য ১৯৫৭ সালে দল ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যাক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিকস্বায়ত্ত্বশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

আওয়ামী লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

ওই বছরের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি  আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এর মধ্যে, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন।

২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নতুন নাম রাখা হয়: 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'।

পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দল ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘসময় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে আস্থার স্থান তৈরি করে নেয় আওয়ামী লীগ।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেন বঙ্গবন্ধু, যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতেই ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসনে নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠন। নেতাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিভেদ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসাবে দেশে ফিরে কয়েক ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন, আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। কিন্তু দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়েছে।

এরপর দেশে নতুন রাজনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়ে সরকারে ফেরে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়।