পাশাপাশি ওই দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাই কোর্টে নিষ্পত্তি করার আদেশ এসেছে সর্বোচ্চ আদালত থেকে।
দুই মাস আগে হাই কোর্টের দেওয়া জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ বুধবার এই রায় দেয়।
জামিননামা বুধবার বিকালেই ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতে দাখিল করেন খালেদার আইনজীবীরা। সেখান থেকে তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে যাবে।
তবে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার থাকায় এখনই খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলছে না বলে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
খালেদার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আপিল বিভাগের রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “মুক্তিতে কিছুটা বাধা আছে। কারণ সরকার নানা কৌশলে চেষ্টা করবে তার মুক্তিটা বিলম্বিত করার জন্য। নিচের আদালতের কতগুলো মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে। সে মামলাগুলোতে তার জন্য আমাদের জামিন নিতে হবে। সেই জামিন নিতে যতটুকু সময় লাগে সেই সময়টুকু পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
খালেদার আরেক আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ওই রায়ের ঘণ্টা তিনেক পর আপিল বিভাগে গিয়ে একটি শর্ট অর্ডার এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির আদেশ চাইলেও আদালত তা নাকচ করে দেয়।
আপিল বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়ার সুযোগ আইনে নেই।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এ সময় আদালত উপস্থিত ছিলেন।
ওই কারাগারে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দাবি করে তাকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার দাবি রয়েছে বিএনপির। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতেও দলটি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
মওদুদ বলেন, “আমরা খুব চেষ্টা করব খুব দ্রুত গতিতে...। আপিল বিভাগ যেহেতু তার জামিন বহাল রেখে দিয়েছেন, এখন নিম্ন আদালতে জামিন পেতে আর খুব বেশি অসুবিধা হবে না। সুতরাং খুব শিগগিরই আমরা চেষ্টা করব ওই মামলাগুলোতে উনার জামিন নিতে।
“কারণ আমাদের তো একটা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগুলো সম্পন্ন করতে হবে। সুতরাং সেই জামিনগুলো পাওয়ার পরে খালেদা জিয়া আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন এবং খুব শিগগির ফিরে আসবেন।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা মওদুদ জানান, নিম্ন আদালতে মোট সাতটি মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ আছে। এর মধ্যে তিনটি মামলা কুমিল্লায়, দুটো মামলা ঢাকার আদালতে; আর নড়াইল ও পঞ্চগড়ে একটি করে মামলা রয়েছে।
“ফলে এই মুহূর্তে তো উনি মুক্তি পাবেন না। এগুলো সরকারের কৌশল। একেবারে ভুয়া-ভিত্তিহীন কতগুলো মামলা। এসব মামলার যে অভিযোগ, তাতে উনার কোনো ভূমিকা ছিল না। আইনের অপব্যবহার এবং অপপ্রয়োগ করে তাকে আসামি করা হয়েছে, যেন তাকে আরও কিছুদিন জেলখানায় রাখা যায়।”
তবে খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী বিএনপির আইন সম্পাদক কায়সার কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সব মিলিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে মোট ৩৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লার আদালতে বিচারাধীন দুটি মামলায় তার বিরুদ্ধে হাজিরা পরোয়ানা জারি আছে (প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট)। আগামী ৭ জুন ওই আদালতে তার হাজিরার তারিখ রয়েছে।
জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তির জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত যে সময় আপিল বিভাগ দিয়েছে, তা যথেষ্ট কি না- এ প্রশ্নে মওদুদ বলেন, “শুনানি শুরু হলে তখন বোঝা যাবে। শুনানির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তখন বোঝা যাবে কতদিন লাগবে। এটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না।”
আর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে খালেদার আপিল নিষ্পত্তি করতে কতটুকু প্রস্তুত জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, “উচ্চতর আদালতের নির্দেশ। এটা অবশ্যই আমাদের নিষ্পত্তি করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আদালতের কাছে এটা আমরা নিবেদন করব যে, আমরা আপিল শুনানি শুরু করার জন্য প্রস্তুত আছি।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও বলেছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাই কোর্টে আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুতি নেবে রাষ্ট্রপক্ষ।
খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন কবে থেকে কার্যকর হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যে দিন হাই কোর্ট ডিভিশন তাকে জামিন দিয়েছিল চার মাসের গণনা সেই দিন থেকে শুরু হয়েছে। তবে আপিল বিভাগে যে কয়দিন স্থগিত ছিল চার মাস থেকে তা বাদ যাবে।”
বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই।
রমনা থানায় দুদকের করা এই মামলার বিচার চলে পুরো দশ বছর। ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়ার পাশাপাশি তার ছেলে তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদকে দশ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
সেই সঙ্গে আসামিদের প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার করে জরিমানা করা হয় ওই রায়ে।
১১৬৮ পৃষ্ঠার ওই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা।
মূল রায়সহ ১২২৩ পৃষ্ঠার আপিল আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার খালাস চাওয়া হয়। আর ৮৮০ পৃষ্ঠার জামিন আবেদনের মধ্যে ৪৮ পৃষ্ঠাজুড়ে ৩২টি যুক্তিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া হয়।
আপিলের গ্রহণযোগ্যতার শুনানি করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ ২২ ফেব্রুয়ারি তা শুনানির জন্য গ্রহণ করে নিম্ন আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করে।
এরপর মামলার নথি নিম্ন আদালত থেকে এনে তা দেখে ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেয় হাই কোর্টের ওই বেঞ্চ।
দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে সর্বোচ্চ আদালত গত ১৪ মার্চ জামিন স্থগিত করে নিয়মিত আলিভ টু আপিল করতে বলে।
এরপর ১৯ মার্চ দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের অনুমতি দিয়ে ৮ মে শুনানির দিন ঠিক করে দেয় আপিল বিভাগ। তিন দিনে সেই আপিল শুনানি শেষে বুধবার জামিন বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দিল সর্বোচ্চ আদালত।
পুরনো খবর