আর বসে থাকার সুযোগ নেই: কামাল হোসেন

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আর ‘ছয়-সাত মাস’ বাকি থাকায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে এখনই রাজপথে নামা উচিত বলে মনে করেন গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 May 2018, 01:38 PM
Updated : 4 May 2018, 05:58 PM

‘স্বৈরাচারের’ পতন ঘটাতে গুলির মুখোমুখিও দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এই আন্দোলনে আইনজীবীদের অগ্রণী ভূমিকা রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন প্রবীণ আইনজীবী কামাল হোসেন।

শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, “এদেশে কোনো দিন স্বৈরাচার টিকে থাকতে পারবে না, গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র কেউ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। গুলি ছুঁড়লে ছুঁড়বে কিন্তু স্বৈরতন্ত্র এখানে চিরস্থায়ী করতে দেওয়া হবে না।

“আসুন আমরা এটা নিশ্চিত করি যে, দলমত নির্বিশেষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমরা পাহারা দেই।”

আন্তর্জাতিক মহল থেকেও বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো হচ্ছে দাবি করে গণফোরাম সভাপতি বলেন, “ওই নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো না। কী লজ্জ্বার ব্যাপার বাইরের থেকে বলে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে যে ২০১৪ এর মতো না। ওরাও একটা রায় দিয়ে দিচ্ছে।”

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে হওয়ায় ২০১৪ সালের ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। এবারও তারা নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকারের দাবি করলেও তাতে সাড়া নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই এ বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নির্বাচনের আর ছয়-সাত মাস হাতে থাকায় এখন আর বসে থাকার সময় নেই বলে মনে করেন কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, “আর তো স্কোপ নেই। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে জনগণের পক্ষ হয়ে সারাজীবন প্রহরীর ভূমিকা পালন করে এসেছি। এবারও প্রহরীর ভূমিকা নেবার জন্য এগিয়ে আসুন। জেলায় জেলায় আইনজীবীরা সবাইকে সম্পৃক্ত করুন। আমি আশাবাদী, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবেই।”

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার কথা তুলে ধরে ওই সময়ের সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, “এই সাউথ হলের ঐতিহ্য রয়েছে ‍যা আজকে আমি স্মরণ করতে চাই।আশির দশকে যখন যিনি ক্ষমতা নিয়েছিলেন তার একটা নীল নকশা ছিল, সেই নীল নকশা অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার মতো এখানে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা।

“ওই সময়ে দেখামাত্র গুলির অর্ডার দিয়েছিল সরকার। আমি বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বলেছিলাম, আমি এটা মেনে নিতে পারি না, এটা অপমানজনক। আমি নিজস্ব সিদ্ধান্তে সেদিন মিছিলের জন্য একা রাস্তায় নেমেছিলাম। কিছুক্ষণ পর পেছনে তাকিয়ে দেখলাম গোটা বার নেমে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের গেটের কাছে গেলে পুলিশের কমিশনার এসে বললেন, স্যার আপনারা আইনজীবী, কী করছেন? দেখামাত্র গুলির অর্ডার আছে।

“আমি বললাম, গুলি করেন। এরপর আমরা মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে যাওয়ার পথে দেখলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সবাই নেমে গেছে, সচিবালয় থেকে সবাই নেমে এসেছে। এর পাঁচ দিন পরই সেই ওই মিলিটারি শাসক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল এই সাউথ হল। ক্ষমতা- শক্তি কোনো কিছুই তাকে রক্ষা করতে পারেনি।”

ড. কামাল হোসেন বলেন, এখন তরুণদের মধ্যে যে শক্তি দেখছেন তাতে আবারও আশাবাদী হয়ে উঠছেন তিনি।

“জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, সংবিধানকে রক্ষা করবে। আর যারা দুর্নীতি করে, রাজনীতির নামে অন্য জিনিস করে তাদের ব্যাপারে জনগণই রাষ্ট্রকে রক্ষা করে যাবে।”

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতি ভবনের শামসুল হক চৌধুরী মিলনায়তনে ‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসন’ শীর্ষক এই মতবিনিময় সভায় গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ছিলেন।

দেশে ‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়’ কামাল হোসেন ছাড়াও বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমান মান্না বিশেষ ভূমিকা রাখবেন প্রত্যাশার কথা জানান তিনি।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “আমি বলব, সম্মিলিত চেষ্টার দরজাটা খুলে দিন, সবাইকে নিয়ে আসুন। নির্বাচনের চারটা মাস সময় আছে। সম্মিলিত বিরোধী দলকে নিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আসুন।

“বিএনপির উদ্দেশ্যে বলব, ছ্যান ছ্যান কইরেন না। খুলনাতে সিটি নির্বাচনে সরকার ভয় পাচ্ছে। দেশবাসী পরিবর্তন চায়, সরকারের গায়ে বাতাসটা লাগতে শুরু করেছে। যতই অসুবিধা হোক না কেনো রণক্লান্ত হইয়েন না। জনগণ তো আছেই।”

আলোচনায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “সমাজের পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা, অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তার লড়াই করতে জনতার শক্তি নিয়ে আমাদের সবাইকে রাজপথে নামতে হবে। সারা দেশের জন্য এটাই শক্তি। লড়াই করে জিততে হবে-এটাই সত্যি।”

আইনজীবী শাহদীন মালিকের মতে, দেশের মানুষের মধ্যে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বিভক্তি তৈরি হয়েছে।

“যে রকম শার্পলি বিভক্ত হয়ে গেছে, দুনিয়ায় এ রকম বিভক্ত দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, আইনের শাসন থাকে না। এই দিক থেকে অবস্থা আরও খারাপ হবে।

“সেজন্য আমাদের পেশাজীবীদের কোথাও না কোথাও লেজুড়বৃত্তি কমিয়ে ২-১টা ইস্যুতে ঐকমত্যে আসতে হবে। তাহলেই আমরা আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নতুন করে যাত্রা শুরু করতে পারব।”

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের বিষয়ে দলমত নির্বিশেষে সব আইনজীবীর ঐকমত্য প্রত্যাশা করেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, “আজকে বিচার বিভাগ ও নিম্ন আদালতগুলো সরকার ও তাদের প্রশাসন কবজা করে ফেলেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট মনে হচ্ছে, সরকারের করায়ত্ব হয়ে যাচ্ছে। আমরা অত্যন্ত শঙ্কিত আগামী দিনে এদেশের মানুষ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি যে আশা ছিল সেই আশা তারা পাবে কি না, সুপ্রিম কোর্টের প্রতি বিগত দিনের প্রতি আস্থা রাখতে পারবে কি না।

“আপনারা দেখেছেন, গণতন্ত্রের নেত্রী ৭৩ বছরের বৃদ্ধ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রীকে কারা অন্তরালে রেখেছে। হাই কোর্ট বিভাগ থেকে জামিন দেবার পরও  সুপ্রিম কোর্ট সেটা স্থগিত করে দিয়েছে। এটা কিসের আলামত দেখছি? আজকে মনে হচ্ছে, প্রধান বিচারপতিকে বিদায় করে দেবার পরে সমস্ত আদালত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছে।”

সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকনের পরিচালনায় মতবিনিময় সভায় আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুর রেজ্জাক খান, সাংবাদিক মাহবুবউল্লাহ, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।