খালেদার ব্রিটিশ আইনজীবী নিয়োগে ‘জামায়াত-যোগ’

ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কারলাইলকে খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে বিএনপি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নিজেদের অভিন্ন অবস্থানের পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

মঈনুল হক চৌধুরী পিয়াস তালুকদার ও কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2018, 06:38 PM
Updated : 23 March 2018, 10:24 AM

আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম বিএনপির এই পদক্ষেপকে দেখছেন জামায়াতকে আরও ‘কাছে টানার’ কৌশল হিসেবে।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, ব্রিটিশ লর্ড সভার এই সদস্যকে আইনজীবী নিয়োগের পেছনে প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মামলাটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনায় নেওয়ার উদ্দেশ্যও রয়েছে তাদের।  

এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের দায়ে পাঁচ বছরের সাজা নিয়ে পুরান ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি হাই কোর্ট থেকে চার মাসের জামিন পেলেও সর্বোচ্চ আদালত তা স্থগিত করেছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

জামিন আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল গ্রহণ করে আগামী ৮ মে তার শুনানির দিন রেখেছে আপিল বিভাগ। সর্বোচ্চ আদালতের ওই আদেশের পরদিন মঙ্গলবার কার্লাইলকে আইনি পরামর্শক নিয়োগের কথা জানান মির্জা ফখরুল।

বিএনপি মহাসচিব এই ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত যুদ্ধাপরাধে জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর তার সমালোচনাকারী এই আইনজীবীর নিয়োগ নিয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

জামায়াতকে আঁকড়ে ধরার জন্যই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আইনজীবী পরিবর্তন করে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন চৌদ্দ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ১৪ দলের এক সমাবেশে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “নিজের আইনজীবীর প্রতি কোনো বিশ্বাস নাই বলে তিনি (খালেদা জিয়া) আজকে একজন বিদেশি আইনজীবীকে নিয়োগ করেছেন। সেই আইনজীবী কে? সেই আইনজীবী হল, ওই একাত্তরের ঘাতক মীর কাসেম আলীর আইনজীবী হয়েছিল লন্ডনের সেই কুখ্যাত আইনজীবী।

মোহাম্মদ নাসিম

“একাত্তরের ঘাতকের লবিস্ট ছিল যে, সেই আইনজীবীকে ঢাকায় আনছে খালেদা জিয়ার দল। তার মানে হল, এখনও খালেদা জিয়া জামায়াতকে ছাড়ে নাই, একাত্তরের ঘাতকদের ছাড়ে নাই।”

পরে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে আন্দোলনের সংগঠক শাহরিয়ার কবির রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লর্ড কারলাইলকে খালেদা জিয়ার মামলার আইনি পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিএনপি আবারও প্রমাণ করল, একাত্তরের গণহত্যাকারীদের বিচারের সময় তাদের অবস্থান যা ছিল, এখনও এক ও অভিন্ন। জামায়াত ও বিএনপির অবস্থান এক-অভিন্ন।”

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি বলেন, “আমাদের ক্ষোভের বিষয় হচ্ছে, লর্ড কারলাইল শুধু একজন আইন ব্যবসায়ী নন, তিনি ব্রিটেনের আইনসভার সদস্য। ব্রিটেনের আইন সভাতে একাত্তরের গণহত্যার নিন্দা করা হয়েছিল। বহু আইন প্রণেতা তখন এই গণহত্যার নিন্দা করেছেন। ব্রিটিশ সরকার এটার নিন্দা করেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম-জনগণ এটার নিন্দা করেছে।”

তার মতে, ব্রিটিশ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে লর্ড কারলাইল তার অফিসকে ‘অপব্যবহার  করেছেন’ জামায়াতের পক্ষে ওকালিতি করার জন্য, আর এখন খালেদা জিয়ার দুনীতি মামলা লড়বেন।

“তিনি পদের সুযোগ নিয়েছেন, প্রথমে গণহত্যাকারীর পক্ষে লড়বার জন্য আর এখন একজন দুর্নীতিবাজের পক্ষে লড়বার জন্য। এটা উচিৎ না, এটা নৈতিকতাবিরোধী। অত্যন্ত অনৈতিক কাজ করছেন লর্ড কার্লাইল। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।”

শাহরিয়ার কবির জানান, পাঁচ বছর আগে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে লর্ড কারলাইলের সঙ্গে তার দীর্ঘ তর্ক হয়েছিল।

“তখনই মনে হয়েছে, লর্ড কারলাইল জামায়াতের ব্রিফ নিয়েছে। মানে জামায়াতকে সে মক্কেল হিসেবে গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ জামায়াত কারলাইলকে তাদের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করেছে। তিনি শুধু পার্লামেন্ট সদস্য নন, তিনি একইসঙ্গে একজন আইন ব্যবসায়ীও। আইন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি তার মক্কেলের ব্রিফ নিবেন যে কোনো মামলা করবেন- এটা তো খুব স্বাভাবিক।”

শাহরিয়ার কবির

বিএনপির এখন কার্লাইলের শরণাপন্ন হওয়াকে খুব বিস্ময় সাজানো কিছু মনে করছেন না ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি।

তিনি বলেন, “কারণ যুদ্ধাপরাধ মামলা তো বিএনপি-জামায়াত একইভাবে দেখে। যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে জামায়াতের যে অবস্থান আইনজীবী হিসেবে লর্ড কার্লাইলেরও অবস্থান তাই। বিএনপির অবস্থানও তাই। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের একজন আইনজীবীকে বিএনপি তাদের একজন আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এটা অবাক হওয়ার মত কিছু ঘটেনি।

শাহরিয়ার কবির জানান, যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মামলায় রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন লর্ড কারলাইল।

“রায়ের পর তিনি যখন সরকারকে চিঠি দিয়েছিলেন তখনই আমরা এটার সমালোচনা করেছি যে, একজন বিদেশি আইন প্রণেতা হিসেবে তিনি আমাদের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে এসব প্রশ্ন কীভাবে তোলেন? আমরা যেমন পৃথিবীর কোনো দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি না, তেমনি অন্য কোনো দেশও আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না।”

এর আগে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এই ব্রিটিশ লর্ড যাতে আবারও একই কাজ না করেন সে বিষয়ে কূটনৈতিক পন্থায় তাকে সতর্ক করার পরামর্শ দিয়েছেন শাহরিয়ার কবির।

“পরিষ্কারভাবে বলতে হবে, অন্য একটি দেশের আইন প্রণেতা হিসেবে আপনার কোনো এখতিয়ার নেই এ বিষয়ে মন্তব্য করার। এটা আমাদের সরকারকে কূটনৈতিকভাবে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে।”