খালেদার জামিন স্থগিতই থাকছে

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের অনুমতি দিয়েছে আপিল বিভাগ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2018, 03:51 AM
Updated : 7 May 2018, 12:22 PM

সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আগামী ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।

জামিন প্রশ্নে আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে দুই সপ্তাহের মধ্যে সার সংক্ষেপ জমা দিতে হবে। আর আসামিপক্ষকে সারসংক্ষেপ দিতে হবে তার পরের দুই সপ্তাহের মধ্যে।

দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেয়।

আদেশের আগে প্রধান বিচারপতি বলেন, “এটা আমাদের সবার সিদ্ধান্ত।”

দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদেশের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আর খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, মাহবুবউদ্দিন খোকন ও জয়নুল আবেদীন।

জামিন প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালতের এ আদেশকে ‘নজিরবিহীন’ ও ‘অপ্রত্যাশিত’ হিসেবে বর্ণনা করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।

মওদুদ আহমদ বলেন, “সর্বোচ্চ আদালত আদেশ দিয়ে দিয়েছে, এখন আইনি লড়াই ছাড়া বিকল্প নেই। আরেকটি হচ্ছে রাজপথের আন্দোলন। সেটি তো সুপ্রিম কোর্টে করতে পারব না। তবে আমরা যারা আইনজীবী আছি, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তার (খালেদা জিয়া) কারামুক্তির জন্য।”

জিয়া এতিমখানা মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জজ আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর থেকে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে বন্দি।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর মামলার নথি নিম্ন আদালত থেকে এনে তা দেখে গত ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।

দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে সর্বোচ্চ আদালত গত ১৪ মার্চ জামিন স্থগিত করে নিয়মিত আলিভ টু আপিল করতে বলে। সোমবার সেই আবেদন মঞ্জুর করে তাদের আপিলের অনুমতি দেওয়া হল।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “এই আদেশকে আমরা ‘নজিরবিহীন’ বলতে বাধ্য হচ্ছি এই কারণে যে অতীতে এই ধরনের আদেশ দেশের সর্বোচ্চ আদালত দেয়নি।”

তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশের নিম্ন আদালতগুলোকে ‘গ্রাস করে’ ফেলেছে।

“উচ্চ আদালতকেও মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। আদালতকে এই জন্য আমি বলেছি, দেশের মানুষ আপনাদের কাছে বিচার পাওয়ার আশা নিয়ে আসে। কিন্তু তারা আশাহত হলে এই বিচারপ্রার্থী মানুষের আস্থা থাকবে না। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমরা মর্মহত। আমরা ব্যথিত।”

শুনানি

সকাল আদেশের শুরুতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, “এটা কিন্তু আমাদের সবার ডিসিশন। সর্বসম্মতিক্রমে এ আদেশ দিচ্ছি।”

এরপর আদালত খালেদা জিয়াকে দেওয়া হাই কোর্টের জামিন আদেশ স্থগিত করে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে আপিলের অনুমতি দিয়ে সারসংক্ষেপ জমা দিতে বলে। মামলাটি আগামী ২২ মে আপিল শুনানির জন্য রাখা হয়।

আদেশের পর আপিল বিভাগ নিয়মিত কার্যক্রমে যায়। কিছু সময় পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, “আমি দুঃখিত। আপনি কী আদেশ দিয়েছেন সেটা বুঝতে পারিনি।”

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা সর্বসম্মত হয়ে এ আদেশ দিয়েছি।”

জয়নুল আবেদীন বলেন, “আমি এটা জানতে চাইনি। কোন যুক্তিতে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করেছেন সেটা জানতে চাই।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা নথি পর্যালোচনা করেছি।”

তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, “আমরাতো মেরিটে (মামলার মূল বিষয়বস্তুতে শুনানি করিনি) বলিনি।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপিলে বলতে পারবেন।”

এরপর খালেদা জিয়ার এ আইনজীবী বলেন, “আপনারা সর্বোচ্চ আদালত। আপনারা যে আদেশ দেবেন শিরোধার্য্য। তবে ২২ মে অনেক দূর। আজকে যেভাবে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করলেন, এটা নজিরবিহীন। অতীতে এই ধরনের ক্ষেত্রে কোনো দিন লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে তো সব (অতীতের সব মামলায়) লিভই (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা উচিৎ ছিল।”

তখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ অফিসারকে ডেকে চার সপ্তাহের জায়গায় দুই সপ্তাহ করে দিতে নির্দেশ দেন।

এ পর্যায়ে জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, “ঠিক আছে। আপনি দুই সপ্তাহ করলেন। ২২ মে তারিখের ওই সময়টা এগিয়ে আনার অনুরোধ করছি।”

এ সময় ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতকে বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্যে এটা করেছে….। দুদক আর সরকারতো একাকার হয়ে গেছে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায় “

এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, “সময়টা কমিয়ে দেন। এপ্রিলে দেন।”

তখন বিচারপতি ইমান আলী বলেন, তখন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি থাকবে।

এ পর্যায়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “ভ্যাকেশনের আগে দেন।”

বিচারপতি ইমান আলী তখন বলেন, “আফটার ভ্যাকেশন।”

জয়নুল আবেদীন বলেন, “আফটার ভ্যাকেশন হলে দিন নির্ধারণ না করলে তো একই থাকল?”

তখন প্রধান বিচারপতি ৮ মে পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত রেখে ওইদিন আপিল শুনানির দিন নির্ধারণ করে দেন।

পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজের অফিসে সাংবাদিকদের বলেন, “আজকের আদেশের প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার এখন আর মুক্তি হবে না। তাকে কারাভোগ করতে হবে।”

খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ““এ ধরনের বক্তব্য নিশ্চয়ই খুব একটি ভাল না। জিনিসটাকে রাজনীতিকীকরণের চেষ্টা করছে।”

খালেদার আইনজীবীদের শেষ চেষ্টা

খালেদা জিয়ার বিষয়ে আদেশের পর নিয়মিত কর্যাক্রমের ফাঁকে বেলা ১১টায় আদালত বিরতিতে যায়। সাড়ে ১১টায় আদালত আবার বসলে আপিল শুনানি এগিয়ে আনতে আরজি জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।

কিন্তু শুনানির জন্য ঠিক করা ৮ মে তারিখ না বদলে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এই মামলা কোনো ধরনের মুলতবি ছাড়া বিরতিহীনভাবে শুনানি করা হবে।”

বিচারকদের সামনে দাঁড়িয়ে খালেদার অন্যতম আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার করজোড়ে বলেন, “আদালতের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন, সকলের পক্ষ থেকে করজোড়ে আবেদন করছি, খালেদা জিয়ার মামলা ভ্যাকেশনের আগেই শুনানির দিন ধার্য করা হোক।”

তখন বিচারক বলেন, “আমরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ৮ মে দিন ধার্য করেছি। আমরা প্রথমে যে আদেশ দিয়েছিলাম আপনাদের অনুরোধে তা পুনঃবিবেচনা করেছি। আদেশ হয়ে গেছে এখন আর পরিবর্তন সম্ভব নয়।”

এরপরও জমির উদ্দিন সরকার অনুরোধ জানাতে থাকলে বিচারক বলে, “আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ৮ মে এই মামলা শুনানির জন্য তালিকায় শীর্ষে থাকবে। কোনো ধরনের মুলতবি ছাড়া বিরতিহীনভাবে শুনানি হবে। ৮ মে না হলেও ৯ মের মধ্যে এই মামলার নিস্পত্তি করব।”

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালত কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।