সাম্প্রতিক অতীত চোখ রাঙাচ্ছে সুন্দরগঞ্জ উপ-নির্বাচনে

পরপর দুই সংসদ সদস্য নিহত হওয়ার পর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনে দ্বিতীয় দফায় উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মঙ্গলবার।

তাজুল ইসলাম রেজা গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2018, 10:09 AM
Updated : 12 March 2018, 10:09 AM

ভোটারদের কাছ থেকে চাপা ‘শঙ্কার’ কথা শোনা গেলেও চারজন প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুষ্ঠুভাবে এই নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদী জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান।

এবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা হলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফরুজা বারী (প্রতীক নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী শামীম হায়দার পাটোয়ারী (প্রতীক লাঙ্গল), গণফ্রন্টের শরিফুল ইসলাম (প্রতীক মাছ) এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) জিয়া জামান খাঁন (প্রতীক আম)।

মাস পনেরো আগে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনের বড়বোন আফরুজা বারীর ‘প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে ধারণা করছে এলাকাবাসী।

নির্বাচনী প্রচারণার শেষ সময়ে সুন্দরগঞ্জের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রার্থীরা জনসংযোগে ব্যস্ত। তারা ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট চান, দোয়া করতে বলেন। তবে প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের মতো উৎসাহ উদ্দীপনা ভোটারদের মধ্যে দেখা যায়নি।

ধর্মপুর গ্রামের রিকশাচালক আব্দুল জোব্বার (৪২) বলেন, “ভোটদিয়া কী হবি? হামার এলাকাত শণিরদশা নাগচে, যাই এমপি হয়, তাই মরি যায়। এমপি মরে, হামরা ভোট দেই। এব্যারকা এ্যাগলে নিয়া ভয়োত আচি।”

সুন্দরগঞ্জ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন নিজ বাড়িতে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দুবৃর্ত্তদের গুলিতে নিহত হন। লিটনকে হত্যার অভিযোগে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) আবদুল কাদের খান গ্রেপ্তার হন। তিনি বর্তমানে কারাগারে বন্দি রয়েছেন।

লিটনের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম মোস্তফা আহম্মেদ গত ১৯ ডিসেম্বর সড়ক দুঘর্টনায় মারা যান। তিনি নিহত হওয়ায় এই আসনে আবার উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে।

সুন্দরগঞ্জের রামজীবন গ্রামের ব্যবসায়ী মাহবুর মিয়া (৫০) বলেন, “উপজেলায় জামায়াতের প্রভাব বেশি। তাই পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে, ভোট দিতে যাব কিনা।”

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর এখানে চার পুলিশ সদস্য হত্যার শিকার হন।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে ও নির্বাচনের দিন অসংখ্য নাশকতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় প্রায় ৩২টি মামলায় বিএনপি-জামায়াতের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। শতাধিক গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।

এছাড়া গত ২৩ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে এই আসনের জামায়াতের সাবেক এমপি মওলানা আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সুন্দরগঞ্জের বাজারপাড়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক বাদশা মিয়া (৪৮) মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের এমপি খুন হওয়া, নাশকতায় একটি দল জড়িত থাকায় প্রশাসন নিরাপত্তা জোরদার করলেও মানুষের মধ্যে ‘আতঙ্ক’ কাজ করছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাইবান্ধা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, “বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সুন্দরগঞ্জে অসংখ্য নাশকতার ঘটনা ঘটে।

“এছাড়া ওই এলাকায় জামায়াতের প্রভাব বেশি। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর এখানে চার পুলিশ হত্যার ঘটনা ঘটে।”

নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের পেছনে এসবই কারণ বলছেন তিনি।

তবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান মনে করেন ‘আতঙ্ক কিংবা ভয়ের কারণ নেই।’

“সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।”

জোর প্রচারে থাকা আওয়ামী লীগ প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা বারী বলেন, “বিপদ-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। এলাকার উন্নয়নে কাজ করছি। এছাড়া আমার ছোটভাই এমপি লিটন এখানে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমার দায়িত্ব সেটাকে লালন পালন ও বড় করা।

“আমি জয়ী হলে ছোট ভাইয়ের অসমাপ্ত উন্নয়ণমূলক কাজগুলো সম্পন্ন করার পাশাপাশি সুন্দরগঞ্জ এবং নেত্রীর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখবো।”

এক সময় জাতীয় পার্টির দখলে থাকা এই আসনে চলতি উপনির্বাচনের লাঙ্গলের প্রার্থী শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “আমি এলাকার উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। এখানে ১৮-৪০ বছর বয়সের ভোটার ৬০-৭০ ভাগ। তাদের সমর্থনে এগিয়ে আছি।”

জাপা প্রার্থীর পক্ষে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, পরিবেশ ও বন মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিছুল ইসলাম মাহমুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা একাধিকবার উপজেলায় সভা সমাবেশ করেছেন।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপনসহ কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটির একাধিক নেতা গত কয়েকদিন থেকে উপজেলার হাট-বাজারে সভা সমাবেশ করে প্রচার চালাচ্ছেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম জানান, লিটন ও গোলাম মোস্তফা নিহত হবার পর দলের নেতা-কর্মী অতীতের আর কোনো ক্ষোভ নাই। সবাই নৌকার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন।

“ছোটভাই লিটন নিহত হওয়ায় তাদের পরিবারের প্রতি উপজেলারবাসীর সহানুভূতি বেড়েছে।”

পনেরটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই আসনে তিন লাখ ৩২ হাজার ৯৪৯ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ রয়েছেন এক লাখ ৬২ হাজার ৪৫৭ জন এবং নারী রয়েছেন এক লাখ ৭০ হাজার ৪৯২ জন।

নির্বাচনের আগের দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম গোলাম কিবরিয়া বলেন, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য ১ হাজার ৭৬০ জন পুলিশ, ৮ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাবের ৪০টি টিম ও ৮৭২ জন আনসার সদস্য সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে সোমবার দুপুরে র‌্যাব-১৩ রংপুরের উইং কমান্ডার আব্দুল আহাদ বলেন, সুন্দরগঞ্জের উপ-নির্বাচনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ নেই। নির্বাচনকে ঘিরে রোববার থেকে র‌্যাব মোতায়েন করা হয়েছে এবং নির্বাচনের পরদিনও থাকবে।