এই প্রথম দণ্ড নিয়ে বন্দি খালেদা

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বন্দি হয়েছেন কয়েক দফায়, বছরের বেশি কারাগারে থাকতে হয়েছে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও; কিন্তু এবার আদালতের সাজা নিয়ে কারাগারে যেতে হল খালেদা জিয়াকে।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2018, 10:03 AM
Updated : 17 Feb 2018, 08:20 AM

বৃহস্পতিবার আদালত দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছর সাজার রায় দেওয়ার পর খালেদা জিয়াকে নিয়ে যাওয়া হল পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে।

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের ২ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতে তার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে এই রায় দিয়েছেন ঢাকার ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান, পুরান ঢাকার বকশীবাজারের বিশেষ এজলাসে বসে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মধ্যে এইচ এম এরশাদের পর খালেদা জিয়াকেই দুর্নীতির দায় নিয়ে কারাগারে যেতে হল।

তিন যুগের রাজনৈতিক জীবনে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে খালেদা জিয়া এবারই সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় পড়েছেন বলে বিএনপি নেতারাও মনে করছেন।

রায়ের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে

রায়ের পর কারাগারের পথে

তারা বলছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ‘সাজানো’ এই রায়ের মাধ্যমে সরকার আসলে বিএনপি চেয়ারপারসনকে ভোট থেকে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।

রায়ের আগের দিন বুধবার সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়াও বলেছেন, “আমাকে রাজনীতি ও নির্বাচনের ময়দান থেকে দূরে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিজেকে ‘নির্দোষ’ দাবি করলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভা-সমাবেশে বক্তব্যে প্রধান প্রতিপক্ষ দলের নেতাকে ‘এতিমদের টাকা চোর’ বলে আসছেন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে থাকলেও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীর বিরোধ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও আলোচিত বিষয়।

এরশাদ আমলে কিংবা ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একসঙ্গে বন্দি হলেও এবারই প্রথম একজনের শাসনামলে আরেকজনকে কারাবাস করতে হচ্ছে।

বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার সময় (সংগৃহীত ছবি)

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার সঙ্গে (সংগৃহীত ছবি)

গত শতকের ৮০ এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার হতে হয় খালেদা জিয়াকে। তখন তাকে সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাড়িটিতে গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল।

সর্বশেষ জরুরি অবস্থার সময় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া। প্রায় ১ বছর ৭ দিন সংসদ ভবনের একটি বাড়িতে বন্দি রাখা হয়েছিল তাকে। পাশের বাড়িতে বন্দি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

ওই সময় খালেদার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খালেদা জামিনে মুক্তি পান।

তারেক ও আরাফাত ও জামিনে মুক্তি নিয়ে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য। মুদ্রা পাচারে এক মামলায় দণ্ড নিয়ে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত অবস্থায় ২০১৫ সালে মারা যান কোকো। মুদ্রা পাচারের আরেক মামলায় সাজা নিয়ে সপরিবারে লন্ডনে রয়েছেন তারেক।

খালেদা জিয়া এখন বড় সঙ্কটে

স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে ব্যর্থ এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের চাপের মুখেই রাজনীতির জটিল পথে নামতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে।

প্রথমে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হন তিনি, এক বছর পর ১৯৮৪ সালে নেন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব; তারপর ৩৪ বছর ধরে একই দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।

বুধবার সংবাদ সম্মেলনে জিয়াপত্নী বলেন, “দলের নেতা-কর্মীদের দাবিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির বিপদসঙ্কুল পথে আমি পা বাড়িয়েছি। আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি ও নিস্তরঙ্গ জীবন বিসর্জন দিয়েছি।”

রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখার পর দুই সন্তান ও পরিবারকে সেভাবে সময় দিতে না পারার কথাও বলেন তিনি।

খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালে ইস্কান্দর মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদারের ঘরে। বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনীর বাসিন্দা ইস্কান্দর ঠিকানা নিয়েছিলেন দিনাজপুরে। খালেদাসহ তার তিন মেয়ে ও দুই ছেলের বেড়ে ওঠা সেখানেই।

খালেদা খানম পুতুলের সঙ্গে ১৯৬০ সালে বিয়ে হয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়ার; স্বামীর সূত্রে তারপর রাজনীতিতে নেমে তিনি খালেদা জিয়া হিসেবেই পরিচিতি পান। 

স্বামী জিয়াউর রহমানের সঙ্গে (সংগৃহীত ছবি)

স্বামীর মৃত্যুর পর আনাড়ি হাতে বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার পর ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিজের আসন পোক্ত করেন খালেদা, হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া বিএনপির জনভিত্তি তৈরি হয় খালেদা জিয়ার হাত দিয়েই।

দুই নেত্রীর যৌথ নেতৃত্বের আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি, প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।

সিলেটে এক জনসভায়

১৯৯১ সাল থেকে পরবর্তী নির্বাচনগুলোর যে কয়টিতে যতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, ততবার ততটিতেই জয়ী হয়েছেন। কোনো বার হারের স্বাদ নিতে হয়নি তাকে।

পাঁচ বছর দেশ শাসনের পর ১৯৯৬ সালে বিতর্কিত একটি নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল খালেদাকে।

পাঁচ বছর বিরোধীদলীয় নেতা থাকার পর ২০০১ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসে বিএনপি; ফের প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা।

ওই শাসনালেই ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হয়ে ওঠেন ছেলে তারেক রহমান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন’ খালেদা সন্তান স্নেহে ‘আপসকামী’ হয়ে ওঠেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি বিএনপি ছেড়ে আসা অনেকের কথায় উঠে আসে।

ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে

সেই শুরুতে দায়িত্ব নেওয়ার কালে একটি ভাঙনের পর জরুরি অবস্থার সময় বিএনপিতে ফের ভাঙন মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেন খালেদা।

জরুরি অবস্থার অবসানের পর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর খালেদা জিয়া বসেন বিরোধী দলের আসনে।

এরপর ২০১০ সালে শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে উৎখাত হওয়ার পর শেখ হাসিনার সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার পর  দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেন তিনি।

গত এক বছরে এভাবে আদালতে যেতে হয়েছে অনেকবার

২০১৪ সালে ভোট ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পরের বছর সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেও ব্যর্থ হন খালেদা; তিন মাস কার্যালয়ে কার্যত বন্দি থাকতে হয় তাকে।

এর মধ্যেই তার বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দায়ের করা মামলাগুলো এগিয়ে চলতে থাকে; বিএনপির ভাষায় ‘সরকারের হস্তক্ষেপে এগুলো বুলেট গতি’ পায়।

জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় রায় হয়েছে, চলছে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলাও। আরও কয়েকটি দুর্নীতির মামলা রয়েছে খালেদার বিরুদ্ধে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সেগুলোরও পরিণতি দেওয়া হতে পারে বলে বিএনপির সন্দেহ।

খালেদার আইনজীবী ও একইসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকনের ভাষায়, তার নেত্রী এখন রাজনৈতিক জীবনের ‘তৃতীয় মহাবিপদে’।