ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় খালেদা জিয়ার

জিয়া এতিমখানার অর্থ নিয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি দাবি করে এই মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2018, 11:20 AM
Updated : 8 March 2018, 05:47 AM

রায়ের পর তাকে কারাগারে যেতে হলে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন তিনি।

এই রায় ঘিরে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন খালেদা জিয়া।

তিনি বলেন, “আদালত রায় দেওয়ার বহু আগেই শাসক মহল চিৎকার করে বলে বেড়াচ্ছে, ‘আমার জেল হবে’। যেন বিচারক নয়, শাসক মহলই রায় ঠিক করে দিচ্ছে।”

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ‘চাপের মুখে’ পদত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন, আদালত চাপ উপেক্ষা করে রায় দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।

নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, “আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। কোনো দুর্নীতি আমি করিনি।

“ন্যায়বিচার হলে আমার কিছু হবে না, আমি বেকসুর খালাস পাব। আর যদি শাসক মহলকে তুষ্ট করার জন্য অন্য কোনো রায় হয়, তাহলে তা কলঙ্কের প্রতীক হয়ে থাকবে।”

মামলা বৃত্তান্ত: এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থের দুই কোটি টাকা জিয়ার নামে ট্রাস্ট গড়ে তাতে সরিয়ে নিয়ে  আত্মসাতের অভিযোগে এই মামলাটি হয় ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। মামলাকারী দুর্নীতি দমন কমিশন পরের বছর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামলাটিতে অভিযোগপত্র দেয়।

মামলায় খালেদার সঙ্গে আসামির তালিকায় তার বড় ছেলে তারেক রহমানও রয়েছেন। অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্যসচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।

এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন বলে দাবি করছেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজ। অপরাধ প্রমাণিত হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেন, জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের কোনো অর্থ তসরুপ হয়নি, সব অর্থ ব্যাংকে রয়েছে এবং সুদে আসলে তা এখন তিন গুণ হয়েছে।

“রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কুয়েতের তৎকালীন আমিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। তার নামকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কুয়েতের আমির যে অনুদান প্রদান করেন, তা তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে নিয়ে আসা, সেই অর্থের বিলি-বণ্টন, তহবিল পরিচালনা অর্থাৎ জিয়া অরফানেজের সঙ্গে আমি কখনোই কোনোভাবে জড়িত ছিলাম না।”

খালেদা জিয়ার দাবি, জিয়া এতিমখানা তহবিলের এক টাকাও তসরুপ হয়নি

বিএনপি চেয়ারপারসন দাবি করেন, তাকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখতেই এই মামলায় ‘সাজানো রায়’ দেওয়া হচ্ছে।

“আমাকে রাজনীতি ও নির্বাচনের ময়দান থেকে দূরে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

তাকে মামলায় ফাঁসাতে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে এই মামলা যারা দায়ের করেছে  তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিৎ। যারা এই মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে, তাদের সাজা হওয়া উচিৎ।”

সরকারের উদ্দেশে খালেদা বলেন, “আমি যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তত। জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। আমি মাথা নত করব না।

“তাদের খালি মাঠে গোল দেওয়া এবং একদলীয় শাসন দীর্ঘায়িত করার খায়েস পূরণ হবে বলে আমি মনে করি না।”

পুরান ঢাকার বকশীবাজারের ‘ক্যাঙ্গারু আদালতে’ এই মামলার রায়ের দিন ঠিক হওয়ার পর দফায় দফায় দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সিলেটে মাজার জিয়ারত করে আসার পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন খালেদা।

 

এই রায় নিয়ে পাল্টাপাল্টি কথার উত্তেজনায় ইতোমধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে জনমনে; পাশাপাশি যে কোনো নাশকতার চেষ্টা ঠেকাতে পুলিশের তৎপরতা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে খালেদা বলেন, “আমার বিরুদ্ধে এক মিথ্যা মামলায় আগামীকাল রায় হবে। এই রায়কে কেন্দ্র করে শাসক দল আমাদের চেয়ে ভীত হয়ে প্রতিবাদের অধিকার, মিছিলের অধিকার প্রশাসনিক নির্দেশে বন্ধ করেছে।

“জনগণের প্রতিবাদের ভয়ে ভীত হয়ে হীন পথ খুঁজে নিয়েছে এই অবৈধ সরকার। সারাদেশে তারা বিভীষিকা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।”

রায় বিপক্ষে গেলে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

তিনি বলেন, “দেশবাসীর প্রতি আমার আবেদন, আমাকে আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হলেও বিশ্বাস করবেন, আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি।

“আপনারা গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, জনগণের সরকার কায়েমের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।”

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রায় ঘিরে বিএনপির নাশকতা চালানোর ইঙ্গিত পাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জোরদার প্রস্তুতি নিয়েছে।

রায় শাস্তি হলে খালেদা জিয়ার জন্য কারাগার প্রস্তুত থাকার কথাও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

খালেদা জিয়া বলেছেন, যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তিনি তৈরি

সংবাদ সম্মেলনে খালেদা বলেন, “যারা গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে বাস যাত্রী পুড়িয়ে মারে, যারা আন্দোলনের নামে বাসে আগুন, পেট্রোল পাম্পে আগুন, রেল স্টেশন পুড়িয়ে দিয়েছে, তারাই আজ আমাদের বিরুদ্ধে মা্মলা করছে।

“আমরা সন্ত্রাসে বিশ্বাস করি না। সারাদেশে প্রকাশ্যে সন্ত্রাস করছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা।”

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, “জনগণের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা প্রদান করবেন না। জনগণের সাথে তথা আমাদের সাথে আপনাদের কোনো বিরোধ নেই।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্তির পর দলীয় সরকার রেখে দশম সংসদ নির্বাচন হওয়ায় তা বর্জনের করেছিল বিএনপি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় চেয়ারপারসনের মামলা নিয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে দলটি।

খালেদা জিয়া সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকারকে আলোচনায় বসতে আবারও আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “এখনও আমরা আশা করে বসে আছি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সেই প্রত্যশা রেখে আহ্বান জানাই, হুমকি-ধমকি ও নির্যাতনের পথ ছেড়ে আসুন। আসুন আমরা আলোচনার মাধ্যমে শান্তির পথে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করি।”

সংবাদ সম্মেলনে কোনো প্রশ্ন নেননি খালেদা জিয়া

বিকালে গুলশানে নিজের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে নিয়ে আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, আবদুল মইন খান, নজরুল ইসলাম খান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

সংবাদ সম্মেলনে ৩৬ মিনিটের বক্তব্যে নিজের রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া।

নিজের বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে চাইলে তিনি বলেন, “আজকে প্রশ্ন নিচ্ছি না, প্রশ্ন আরেকদিন। পরে আপনাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলব, প্রশ্ন শুনব। এখন না।”

এরপর নিজের আসন থেকে উঠে সাংবাদিকদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, “ইনশাল্লাহ, আবার দেখা হবে। আপনারা ভালো থাকবেন।”