মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও যথাযথভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন একাত্তরের এই যোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কমরেড মণি সিংহের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক আলোচনা সভায় এসব বলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোপথে দেশকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে সিপিবি সভাপতি সেলিম বলেন, “আজকে দেশকে সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের কাছে নতজানু রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে এবং এই উল্টোপথের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে।
“পঁচাত্তরে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হল, সেই পটপরিবর্তনের ফলে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের রেললাইন থেকে পাকিস্তানি ধারার রেললাইনে সরিয়ে দেওয়া হল। দুঃখের বিষয় আজও আমরা সেই মুক্তিযুদ্ধের লাইনে আর দেশকে ফিরিয়ে আনতে পারি নাই। এখন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান এরশাদ যে পথে হেঁটেছে সেই একই পথে বর্তমান সরকারও তার নীতি পরিচালনা করছে।”
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল নয় মাসের ঘটনাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সেই সশস্ত্র পর্বটাকে তৈরি করার জন্য পদে পদে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে, নানাজনের অবদানের ভেতর দিয়েই ইতিহাস তৈরি হয়েছে।
“এবং সেই পথ দেখার কাজ ইতিহাসের এক এক পর্বে এক একজনকে এক একভাবে পালন করতে হয়েছে। অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া যেসব ব্যক্তির নাম আমরা স্মরণ করি তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মণি সিংহ।
“ব্রিটিশ আমল নাই, পাকিস্তান আমল নাই। এখন মণি সিংহের পরিচয় এবং তার কর্মকাণ্ড সব বাঙালির কাছে, দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার যে সুযোগ আছে, সেই সুযোগ থেকেও আমাদের দেশবাসীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কেননা ইতিহাস এমনভাবে লেখা হচ্ছে যেখানে হয়তো মণি সিংহের তেমন কোনো অবদানের কথা দেশবাসী একেবারেই জানতে পারছে না।
“কারও কারও দ্বারা বিশেষ করে একটি মহল দ্বারা এমন একটা ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের সমস্ত ইতিহাস কেবলমাত্র একটা ব্যক্তিই রচনা করেছে- এই কথাটা ঠিক না।”
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনি সিংহই বাঙালি জাতির সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন বলে দাবি করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
তিনি বলেন, “বাঙালি জাতির সশস্ত্র সংগ্রাম ১৯৭১ সালে, কিন্তু এই জাতির সশস্ত্র গণআন্দোলন প্রথম হয়েছিল মণি সিংহের নেতৃত্বে চল্লিশের দশকের শেষভাগে এবং পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে, যেটাকে টংক আন্দোলন বলে। এই আন্দোলন পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনীকে মোকাবেলা করে ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চল গারো পাহাড়ের পাদদেশের সমস্ত এলাকাকে কার্যত স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিল।”
“ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিরা কোনো দিন চাইত না তার কথাগুলো সাধারণ মানুষ শুনুক বা জানতে পারুক সেজন্যই তাকে আটক করে রাখা হত। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে সে যাতে দিনের আলোতে বাইরে বের হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হত।”
মণি সিংহের ছেলে সিপিবি নেতা ডা. দিবালোক সিংহ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। মণি সিংহের স্বপ্নেরও বাস্তবায়ন হয়নি।”
নারী নেত্রী লুনা নূর বলেন, “এই প্রজন্ম কমরেড মণি সিংহকে চেনে না। মণি সিংহ লড়াকু সংগ্রামী চেতনার মধ্য দিয়ে তার কাজে কর্মে ছাপ রেখে গেছেন। তিনি আদর্শিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।”
মণি সিংহের চেতনাকে ধারণ করে তার আদর্শকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী, ডা. অসিত বরণ রায় ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জিএম জিলানী শুভ বক্তব্য দেন।
কমরেড মণি সিংহ মেলা উদযাপন কমিটির আয়োজনে আলোচনা সভার পর গণসঙ্গীত পরিবেশনা, কবিতা পাঠ ও কমরেড মণি সিংহের ওপর প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।