মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ‘সকলের নেতা’

কারও কাছে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক গুরু, কারওবা সহযোদ্ধা, কেউ আবার তাকে মানতেন অভিভাবক; মহিউদ্দিন চৌধুরী কারও কারও কাছে এখনও ‘মেয়র সাব’।

মিন্টু চৌধুরীও মিঠুন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2017, 07:19 AM
Updated : 15 Dec 2017, 08:43 PM

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় নানা রাজনৈতিক সংকটে সম্ভাবনায় চট্টগ্রামের মানুষের পাশে থেকে এই আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে উঠেছিলেন ‘চট্টল বীর’। তার মৃত্যুতে প্রশংসা ঝরেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কণ্ঠেও।

বৃহস্পতিবার রাত ৩টার পর নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে মহিউদ্দিনের বড় ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তার বাবার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করার পরপরই দলের নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত ৭৩ বছর বয়সী মহিউদ্দিনকে বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সন্ধ্যার দিকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সন্ধ্যার পর থেকে দলের নেতাকর্মী-শুভানুধ্যায়ী এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষ হাসপাতালে ভিড় করতে থাকে।

শুক্রবার সকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মরদেহ নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেইটের চশমা হিলে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন তাদের প্রিয় নেতাকে শেষবার দেখতে।

কেবল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নন, ভিড়ের মধ্যে দেখা যায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, রিকশা চালক- সব শ্রেণি পেশার মানুষকেই।

তিন মেয়াদে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন প্রায় এক যুগ। চশমা হিলের যে রাস্তায় তার বাসা, তাকে মানুষ চেনে ‘মেয়র গলি’ নামে। 

মহিউদ্দিন চৌধুরীকে শেষবার দেখতে এসে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা একজন মহান নেতাকে হারিয়েছি। চট্টগ্রাম হারিয়েছে তার অভিভাবককে।”

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন নেতাকর্মীদের অনেকে

বিভিন্ন সময়ে অনেক বিভেদের মধ্যেও দলের নেতাকর্মীদের কাছে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।

বাবুল বলেন, “সব দলের নেতাকর্মীদের কাছেই তিনি একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন সকলের নেতা। যে কোনো কঠিন সময়ে তিনি চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে দাঁড়াতেন।”

মহানগর আওয়ামী লীগের আরেক সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, “মহিউদ্দিন চৌধুরীর চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা হল, তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়।”

১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আরও দুই মেয়াদে ২০১০ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন মহিউদ্দিন। ওই বছর নিজের রাজনৈতিক শিষ্য এম মনজুর আলমের কাছে ভোটে হেরে মেয়র পদ হারান।

সেই নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন পাওয়া মনজুর আলম পরে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টার পদ নিয়েছিলেন। তবে ‘গুরু’ মহিউদ্দিন প্রসঙ্গে মনজুরের কণ্ঠ শ্রদ্ধা-ভালবাসায় আপ্লুত শোনা গেছে সব সময়। শুক্রবার সকালে তিনিও ছুটে এসেছিলেন প্রয়াত নেতার বাসায়।

মনজুরের মেয়াদ শেষে ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনের আগেও মেয়র প্রার্থী হিসেবে মহিউদ্দিনের নাম শোনা যাচ্ছিল জোরে সোরে। তবে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত মহিউদ্দিনের বদলে মনোনয়ন দেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনকে। কেন্দ্রের নির্দেশে মহিউদ্দিন সে সময় নাছিরের পক্ষে প্রচারেও নামেন।

এরপর গত দুই বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স, বন্দর ব্যবস্থাপনা, ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে মেয়র নাছিরের কঠোর সমালোচনা করতে দেখা গেছে মহিউদ্দিনকে।

ক্ষমতাসীন দলের মহানগর কমিটির দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ বন্দরনগরীর রাজনীতিতে ছড়িয়েছে উত্তাপ। আবার একমঞ্চে হাত মিলিয়ে, পরস্পরকে মিষ্টি খাইয়ে দুজনে আবার মিলেও গেছেন। 

সভাপতির মৃত্যুর পর আ জ ম নাছির বলেন, “মহিউদ্দিন ভাইকে হারানোর ব্যথা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। শুধু নগর আওয়ামী লীগ নয়, পুরো চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তিনি অভিভাবক।”

মহিউদ্দিন চৌধুরীকে শেষবার দেখতে তার বাসায় আসেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন দলের নেতারা

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর নেতাকর্মীরা ভিড় করেন তার বাসায়

বহুতল পাকা বাড়ির সামনে পুরনো বাড়ির টিনশেড অংশটি অক্ষত রেখেছিলেন মহিউদ্দিন। সেই ঘরে বসেই কথা বলতেন নেতাকর্মী-অনুসারীদের সঙ্গে। সেই ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গাড়ির ভেতরে রাখা হয়েছিল মহিউদ্দিন চৌধুরীর মরদেহ।

ভিড়ের জন্যে সিটি করপোরেশনের তিন নারী পরিচ্ছন্নতা কর্মী এগোতে পারছিলেন না। তাদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ এক নারীর অনুরোধে নীরবে পথ করে দেন দুই সেচ্ছাসেবক।

কফিনের দিকে একনজর তাকিয়ে বিমর্ষ তিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ফিরতি পথ ধরেন। তাদের কাছে এখনো মহিউদ্দিনই ‘মেয়র সাব’।

খোরশেদ নামের এক রিকশাচালক ছুটে এসেছিলেন বায়েজিদ বোস্তামি থেকে। তিনি বলেন, “মহিউদ্দিন চৌধুরীর মত নেতা আর হবে না। তিনি আমাদের মত গরিবদেরও ভালোবাসতেন।”

বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের ভাষায়, এই ভালোবাসাই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ‘গণমানুষের নেতায়’ পরিণত করে।

“তিল তিল করে তিনি আজকের অবস্থানে এসেছেন। মানুষের দাবিতে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তাই তিনি গণমানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। চট্টগ্রামকে ঘিরে তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন তা বাস্তবায়ন করাই আমাদের সবার দায়িত্ব।”

প্রবীণ এই নেতার মৃত্যুর খবরে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।

“প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন উনাকে মন্ত্রী করতে, চেয়েছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য করতে। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাই রাজি হননি। চট্টগ্রাম ছেড়ে গিয়ে তিনি কিছুই চাননি।”

শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নন, রাজনীতির মাঠের প্রতিপক্ষের নেতারাও ছুটে এসেছেন মহিউদ্দিনের কফিনের পাশে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “রাজনীতিতে আমাদের দ্বিমত ছিল, কিন্তু হৃদ্যতা ছিল সব সময়। এরকম নেতা আর হবে না। তার অবস্থান ছিল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিপরীতে।”

আরেক বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, “হয়ত আমরা ভিন্ন দল করতাম। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বির্নিমাণ ছিল তার সারাজীবনের সংগ্রাম।

নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে বিকালে লালদিঘী ময়দানে মহিউদ্দিনের জানাজায় এসেছিলেন বিএনপিকর্মী জহিরুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ রকম নেতা আর আসবে না। তিনি আওয়ামী লীগ করলেও তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থেকেই জানাজায় এসেছি। কে কোন দল করত তা না দেখে তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতেন।” 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ ও এনামুল হক শামীম, চট্টগ্রামের সাংসদ আফসারুল আমীন, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ ছালাম, সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরীও মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় এসেছিলেন তাকে শেষবার দেখতে। 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরী

মহিউদ্দিন চৌধুরী, যখন যুবক

ষাটের দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হলেও পরে পালিয়ে চলে যান ভারতে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে প্রতিশোধ নিতে মহিউদ্দিন গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’। কিন্তু পরে তাকে পালিয়ে কলকাতায় চলে যেতে হয়। ভারত থেকে তিনি দেশে ফেরেন ১৯৭৮ সালে।

সাড়ে পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের মহানগর কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী তাকে বর্ণনা করেন তার রাজনৈতিক প্রশিক্ষক হিসেবে।

তিনি বলেন, “উনি অনেক বড় মাপের নেতা ছিলেন। কর্মীবান্ধব, জনবান্ধব দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন। চট্টগ্রামকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। এজন্যই তিনি ঢাকায় কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর চট্টগ্রামে চলে আসেন। চট্টগ্রামেই তিনি শেষ বিদায় নিলেন।”

বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য সারাদেশে পরিচিতি পেলেও মহিউদ্দিন নিজেকে ধরে রেখেছেন চট্টগ্রামের রাজনীতির গণ্ডিতেই। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে দুইবার সংসদ নির্বাচনে হারের পর আর কখনও সংসদ নির্বাচনে তিনি লড়েননি।

তবে চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারে।

গতবছর ডিসেম্বরে জন্মদিনে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাবে মহিউদ্দিন বলেছিলেন, “টিল ডেথ, আই উইল ডু ফর দ্য পিপল অব চিটাগং, চট্টগ্রামের মানুষকে আমি ভালোবাসি।”

কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন গৃহকর বাড়ানোর ঘোষণা দিলে তার বিরোধিতায় আন্দোলনে নামেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে পৌরকর বাড়ানোর ওই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়।

প্রয়াত এই নেতার কফিন জুমার পর নিয়ে যাওয়া হয় দারুল ফজল মার্কেটে দলীয় কার্যালয়ে। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষ তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায়।

আসরের পর নগরীর লালদীঘি ময়দানে জানাজা শেষে সন্ধ্যায় চশমা হিল মসজিদ কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

আরও পড়ুন