দুই মামলায় খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

একই দিনে দুর্নীতি ও জাতীয় পতাকার মানহানির দুটি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2017, 06:02 AM
Updated : 12 Oct 2017, 09:40 AM

এর মধ্যে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে হাজির না থাকায় বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান।

সেই সঙ্গে এ মামলার অপর দুই আসামি মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন তিনি। 

আর স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে দেশের মানচিত্র এবং জাতীয় পতাকার মানহানি করার অভিযোগে আরেক মামলায় সমন জারির পরও আদালতে না আসায় বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার মহানগর হাকিম নূর নবী।

গত জুলাই থেকে লন্ডনে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি যাতে দেশে আসতে না পারেন, সেজন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এক দিনে দুই মামলায় সরকার এভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করিয়েছে।” 

পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে বিএনপি সমর্থক জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে আদালতপাড়ায় বিক্ষোভ মিছিলও করেছে। 

এর আগে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে দুই বছর আগে বাসে পেট্রোল বোমা মেরে আটজনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলায় গত মঙ্গলবার খালেদা জিয়াসহ ‘পলাতক’ আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

‘এতিমখানা দুর্নীতি’

বিগত জরুরি অবস্থার সময় দুদকের দায়ের করা জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ‌্যগ্রহণ শেষে খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা ছিল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি। কিন্তু দফায় দফায় তার আইনজীবীদের সময়ের আবেদন ও অনাস্থার কারণে এখন পর্যন্ত সেই শুনানি হয়নি।

এর মধ্যে খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য গত ১৫ জুলাই লন্ডনে চলে যান। এ মামলার আরেক আসামি খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানও গত নয় বছর ধরে সেখানে রয়েছেন।

এদিকে নয় বছর আগের একটি রুল শুনানি করে গত ৯ অগাস্ট এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে স্থায়ী জামিন দেয় হাই কোর্ট। রায়ে বলা হয়, স্থায়ী জামিন দেওয়া হলেও তিনি এর অপব্যবহার করলে বিচারিক আদালত জামিন বাতিল করতে পারবে।

খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী নুরুজ্জামান তপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার লন্ডনে পা ও চোখের ডাক্তার দেখানোর জন্য অ্যাপয়েনমেন্ট থাকায় সেই নথি দাখিল করে আত্মপক্ষ সমর্থণের শুনানি আবারও পেছানোর আবেদন করেন আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া।

কিন্তু বিচারক তখন প্রশ্ন তোলেন, নিয়মিতভাবে প্রতি বৃহস্পতিবার এ মামলার শুনানির তারিখ থাকে, এটা জানার পরও বিএনপি নেত্রীর জন্য কেন এই দিনেই ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট করা হয়। 

এ মামলায় দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এ সময় বিচারককে বলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বহুবার তারিখ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু খালেদা জিয়া আদালতে আসেননি। বারবার সময়ের আবেদন করে এই শুনানির পর্ব দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে।

“তিনি যদি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে না আসেন, তাহলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তা না হলে তিনি আসবেন না, পালিয়ে যাবেন।”

এরপর বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানি পেছানোর আবেদন নাকচ করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

খালেদার আইনজীবীরা পরোয়ানা জারির আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে বিচারক তাও নাকচ করে দেন বলে দুদকের অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ আবুল হাসান জানান।

এদিকে এ মামলার অপর দুই আসামি কাজী সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অস্থায়ী জামিনে ছিলেন।

এদিন তারা জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করলে বিচারক তা নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন এবং দ্রুত এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে যান বলে আইনজীবীরা জানান।

পুরান ঢাকার বকশিবাজারে কারা অধিদপ্তরের মাঠে বিশেষ জজ আদালতের এই অস্থায়ী এজলাসেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচার চলছে। দুই মামলাতেই শুনানির পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে ১৯ অক্টোবর।

এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক।

তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ অভিযোগ গঠন করে খালেদাসহ ছয় আসামির বিচার শুরু করেন।

মামলার আসামিদের মধ্যে খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান আছেন লন্ডনে। আর সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক।

‘পতাকার মানহানি’

আওয়ামী লীগ সমর্থক সংগঠন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকীর করা মানহানির মামলায় সমন জারির পরও খালেদা জিয়া আদালতে হাজির না হওয়ায় মহানগর হাকিম নূর নবী তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন বলে এ আদালতের পেশকার মো. ইখতিয়ার রহমান জানান।

মামলার বাদী এ বি সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপি নেত্রী আইনের পরোয়া করেন না। আদালতের সমন পেয়েও আসেন না। আদালত আজ তাই পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছেন।”

২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার হাকিম আদালতে এবি সিদ্দিকীর করা এ মামলার আর্জিতে বলা হয়, স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে জাতীয় পতকা তুলে দিয়ে খালেদা জিয়া দেশের মানচিত্র এবং জাতীয় পতাকার ‘মানহানি ঘটিয়েছেন’।

ঢাকা মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলাম সেদিন বাদীর আর্জি শুনে তেজগাঁও থানা পুলিশকে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এ বি এম মশিউর রহমান চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি যে প্রতিবেদন দেন তাতে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়।

সেখানে বলা হয়, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রী বানান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইতোমধ্যে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

“কিন্তু তারা ক্ষমতায় থাকাকালে মন্ত্রিত্বের সুবিধা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তাদের বাড়ি এবং গাড়িতে ব্যবহার করেছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পতাকাকে স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে তুলে দিয়ে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক জনগণের মর্যাদা ভূলণ্ঠিত করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৫০০ ধারার মানহানির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।”

এ বি সিদ্দিকীর মামলার আর্জিতে খালেদা জিয়ার পাশাপাশি তার প্রয়াত স্বামী এক সময়ের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকেও আসামি করার কথা বলা হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের আইনে মৃত ব্যক্তির বিচারের সুযোগ না থাকায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। 

গত  ২২ মার্চ বিচারক প্রতিবেদনটি আমলে নেন এবং পরে ২০ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন।  এরপরও খালেদা জিয়া হাজির না হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন এ বি সিদ্দিকী।