‘কঠিন’ নির্বাচন উৎরাতে সতর্ক কৌশলে আ. লীগ

টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের জন্য একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ খুব সহজ হবে না বলে ভোটের দুই বছর আগে থেকেই সেই বাধা পেরোতে কৌশল নিয়ে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

শামীম আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2017, 04:12 PM
Updated : 23 July 2017, 04:42 PM

প্রয়োজনে জোট সম্প্রসারণের আভাস দিয়ে তিনি বলছেন, নির্বাচনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগের কৌশলগত পরিবর্তন হতে পারে। তবে ‘শেকড়’ থেকে তারা কখনও সরবেন না।

এছাড়া দলীয় কোন্দল নিরসন, প্রার্থী মনোনয়নের জন্য একাধিক জরিপ, তৃণমূলের মতামত গ্রহণ এবং সমালোচিত সংসদ সদস্যদের শুদ্ধ হতে সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে হিসেবে রেখে এসব কৌশল নিলেও ভোটে আসতে দলটির দেওয়া শর্তের বিষয়ে অনমনীয় আওয়ামী লীগ।

ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, “এই সব আস্কারা দিলে দেশের স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

দলীয় নেতাদের সঙ্গে কর্মসূচিতে ওবায়দুল কাদের

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ভোটে নারাজ বিএনপি জোটের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের আড়াই বছরের মাথায় ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন ওবায়দুল কাদের।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা-ঘাটে উপস্থিত হয়ে কর্মকর্তাদের কাজ নিয়ে জবাবদিহি ও জনগণের বক্তব্য শোনায় আলোচিত কাদের এরইমধ্যে দেশের অনেক এলাকায় দলীয় সভায় অংশ নিয়েছেন।

সেই অভিজ্ঞতা এবং দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে বৃহস্পতিবার সেতুভবনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন ওবায়দুল কাদের।

নির্বাচনের প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমান যারা সংসদ সদস্য আছেন, তাদের মধ্যে কার কী অবস্থা তা নিয়ে জরিপ হচ্ছে। বেশ কয়েকটি সংস্থা, এর মধ্যে বেসরকারি সংস্থাও আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে একটি, পেশাজীবীদের পক্ষ থেকেও একটা জরিপ চলছে, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার জরিপ তো আছেই।”

আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা থেকে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী মনোনীত করা হয়

শুধু জরিপ নয়, দলীয় পর্যায়েও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘ক্লোজলি মনিটর’ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূল নেতাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

“ময়মনসিংহ-বরিশাল ছাড়া সব কটিতে প্রতিনিধি সভা করা হয়েছে। আমরা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বক্তব্য শুনছি, আগামী দিনের প্রার্থীদের নিয়ে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করছে, এর মধ্য দিয়ে তাদের মতামত জানতে পারছি।

“নির্বাচনের সময় তৃণমূলকে একটা চয়েস দেওয়া হবে প্রার্থী বাছাইয়ে, এখন তৃণমূলে প্রার্থী বাছাইয়ের নিয়ম আছে তিনজন পর্যন্ত নাম পাঠাতে পারে, যেটা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তৃণমূলের একটি পছন্দ থাকবে। সেই চয়েসটাও জরিপের সাথে মিলিয়ে প্রার্থীবাছাই করে মনোনোয়ন দেওয়া হবে।”

নির্বাচনে নতুন মুখ

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় নতুন মুখ আসার সম্ভাবনার কথা বলেন ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, “আগামীতে নতুন মুখ আসবে, বেশ কিছু নতুন মুখ আসবে, আমি অবশ্য এ মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না।”

ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে ওবায়দুল কাদের

বর্তমানে যেসব সাংসদের নির্বাচনী এলাকায় ভাবমূর্তি সংকট রয়েছে তাদের শোধরাতে সময় বেঁধে দেওয়ার কথা জানিয়ে কাদের বলেন, “এখন যারা আছে তাদের কর্মকাণ্ডে বা তাদের রেপুটেশনে যদি কোনো ঘাটতি থাকে, যাদের ইমেজ সংকট আছে জনগণের কাছে, তাদের শুদ্ধ হওয়ার জন্য সময়সীমা দিয়েছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে শুদ্ধ করে নাও।

“এই অবস্থায় তারা শুদ্ধ হয়ে যদি জনগণের মাঝে তাদের রেপুটেশন ফিরিয়ে আনতে পারে তাহলে আমরা অবশ্যই মনোনয়ন দেব।”

দলীয় কোন্দল ‘সামাধান হচ্ছে’

বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে উদ্যোগী হওয়ার কথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “যেখানে দ্বন্দ্ব বা অভ্যন্তরীণ সংকট আছে, সেখানে ডেকে ডেকে সমস্যা সমাধান করছি। গতকালও বেশ কয়েকটি সংকট নিয়ে কথা বলেছি।

“আমরা প্রতিদিনই সংকট নিয়ে আলোচনা করছি, সাংগঠনিক সংকট থাকলেও মীমাংসা করে দিচ্ছি। বড় দলে বড় সংকট থাকবে এটা স্বাভাবিক।”

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের বিরোধ প্রায়ই সংবাদ শিরোনামে আসে, ওই দুই নেতাকে নিয়ে ওবায়দুল কাদের

অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা প্রতিযোগিতা যা-ই থাকুক না কেন দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার পক্ষেই সবাইকে কাজ করতে হবে বলে নেতাদের হুঁশিয়ার করা হচ্ছে বলে জানান কাদের।

“নবাগত অনেকে আছে ইলেকশন করতে চাইবে, আবার দলেরও অনেকের ইচ্ছা থাকতেই পারে, সেও স্বপ্ন পোষণ করতে পারে, সেও চেষ্টা করছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, এখন কোনো প্রার্থী নেই, এখন প্রার্থী নৌকা। যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে সে-ই আমাদের প্রার্থী, তার পক্ষেই কাজ করতে হবে।”

কৌশলে পরিবর্তন হলেও ‘শেকড়ে থাকবে’ আওয়ামী লীগ

কট্টর ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস নিয়ে সমালোচনার মুখে থাকা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া এই দল তার ‘শেকড়’ থেকে সরবে না।

ওবায়দুল কাদের বলেন, “এলায়েন্সের বিষয় হল কৌশলগত। যারা কনফিউশনে আছে আওয়ামী লীগের কৌশলগত পরিবর্তন নিয়ে, আমি এটি পরিষ্কার করে বলতে চাই- সময়ের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের কৌশলগত পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগ তার শেকড় থেকে কখনও এক বিন্দুও সরে যাবে না।

গণভবনে হেফাজত আমির শাহ আহমেদ শফির সঙ্গে এই বৈঠক থেকে প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে মত দেওয়ার পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসার সনদের স্নাতকোত্তর স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়

“আমরা আমাদের শেকড়ের বন্ধনে আবদ্ধ, কৌশলগত পরিবর্তন আসছে আসবেই।”

তাদের জোটে কে আসবে আর কে বেরোবে সে বিষয়ে এখনই স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না আওয়ামী লীগ নেতা কাদের। তবে অনেকের জন্যই পথ খোলা রেখেছে তারা।

ওবায়দুল কাদের বলেন, “জাতীয় পার্টি বা ১৪ দলের শরিকরা এখানে তরিকত ফেডারেশনও আছে, গতবার তারা আমাদের জোটে ছিল, এরকম আরও অনেকেই আসতে পারে।

“এলায়েন্সের একটি প্রতিক্রিয়া জনমনে থাকে, বিএনপিও তো বিরাট এলায়েন্স, এরশাদ ও এলায়েন্স এর কথা বলেছেন, শেষ পর্যন্ত কোথায় থাকেন এটি বড় কথা, সে সময় এখনও আসেনি।”

নির্বাচনে ‘আসন কমবে’

২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে দুই মেয়াদে সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনে আসন কমবে বলে মনে করেন ওবায়ুল কাদের।

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ দুইবার ক্ষমতায় আছে, এটি থার্ড টাইম, থার্ড টাইম নির্বাচনে জেতা খুব টাফ, তুরস্কে এরদোয়ানের প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার ভোট কমেছে, তৃতীয়বারে তার ভোট অনেক কমেছে।”

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধ সভা

দলীয় মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের আচরণের কারণে ভোট কমতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যেহেতু আমরা পাওয়ারে রয়েছি, পাওয়ারে থেকে দাপট দেখানো ক্ষতি করে। তারপরও আমরা হিসেব করেছি, আমরা হয়ত গতবারের মতো অত আসন পাব না, আসন কমবে, তবে ইনশাআল্লাহ বিজয়ের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী।”

এই আশার রসদ হিসেবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলছেন কাদের।

তার ভাষ্যমতে, “গত ২৮ বছরে যে উন্নয়ন হয়নি সে উন্নয়ন আমরা গত তিন-সাড়ে তিন বছরে করেছি। এ রেকর্ড আছে বাংলাদেশের জনগণই জানে, সেটার প্রমাণ আছে।”

শহর ও গ্রামের ভোটারদের মধ্যে পার্থক্য দেখছেন ওবায়দুল কাদের: “শহরের ভোটারদের মধ্যে নানা টানাপড়েন থাকে, নানা ঘটনায় আলোড়িত হয়, হলি আর্টিজানের প্রতিক্রিয়া থাকে। তবে গ্রামের লোকেরা উন্নয়ন ও আচরণকে প্রাধান্য দেয়।”

বিএনপি নিয়ে ভাবনা

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশলে বিএনপিকে ভোটে আনার পরিকল্পনা আছে কি না প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, “নির্বাচনে কৌশল থাকবে জয়ের জন্য, আমরা চাই বিএনপি আসুক, ফাঁকা মাঠে আমরা গোল দিতে চাই না।”

বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কেন পদক্ষেপ, তারা নিজরাই আসবে, বিএনপিকে কি আমরা করুণা বিতরণ করব? এটি তার অধিকার নির্বাচনে আসা। সরকার চায় তারা নির্বাচনে আসুক।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত নির্বাচনের আগে ছোট আকারের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, যাতে অংশ নিতে বিএনপিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

মুজিবনগর দিবসে মেহেরপুরে জনসভায় ওবায়দুল কাদের

এবারও ওই রকম কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, “সেটা তো নির্বাচন কমিশন করবে। প্রধানমন্ত্রী সে প্রস্তাব দেবে কি না সে প্রয়োজন আমরা এখনও অনুভব করছি না। কারণ বিএনপিকে গতবার ডেকে পজিটিভ কোনো রেসপন্স পাইনি, পেয়েছি গালিগালাজ। তাদের সাথে ওয়ার্কিং আন্ডারস্ট্যান্ডিং কীভাবে হবে?”

নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপি নেতারা একেকজন একেক কথা বলছেন দাবি করে কাদের বলেন, “একজন বলছে, যত বাধা আসুক বিএনপি নির্বাচনে যাবেই। আরেকজন বলে নির্বাচনের সহায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে যাবেন না।

“বর্তমান সরকার তো সহায়ক সরকার থাকছেই। নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা থাকবে না, রুটিন ওয়ার্ক করা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। আমরা নির্বাচনের আগে সংবিধান পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করছি না, বার বার এই সব আস্কারা দিলে দেশের স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সভায় ওবায়দুল কাদের

শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু ভোট হবে না বলে বিএনপির অভিযোগকে অহেতুক বলেন ওবায়দুল কাদের: “আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিনি। তিনি কারচুপি করে, ষড়যন্ত্র করে, জালিয়াতি করে ক্ষমতায় আসবেন, এমন মনমানসিকতা তার নেই। শেখ হাসিনা এ কাজ করবে না।”

নির্বাচনে না এলে বিএনপি ভুল করবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিএনপি অহেতুক ভয় পাচ্ছে। এ ইলেকশনটা তারা করুক, তারা তো এখন কোথাও নেই। দেশবাসী তো সাক্ষী আছে, সারা বিশ্ব থেকে অবজারভাররা আসবে।”

বিএনপি ক্ষমতায় এলে কী হবে, সেই শঙ্কাও আছে

বিএনপি ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কী পরিণতি হবে সে বিষয়ে তারা অবহিত বলে মনে করেন ওবায়দুল কাদের।

যুবলীগের অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের

তিনি বলেন, “২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন হাজার হাজার কর্মী ঘরছাড়া হয়েছে, আমাদের ২১ হাজার নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, আমাদের কতজন গুম হয়েছে তার হিসাব নেই।

“আমাদের নেতাকর্মীদের এটা মনে আছে, বিএনপির মতো দল ক্ষমতায় আসলে ২০০১ সালের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে।”