রাডার দুর্নীতি মামলায় এরশাদ খালাস

রাডার কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে দুই যুগ আগের এক মামলা থেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদসহ আসামিদের সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2017, 10:27 AM
Updated : 19 April 2017, 12:35 PM

ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কামরুল হোসেন মোল্লা বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। 

মামলার চার আসামির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ ছাড়াও বিমান বাহিনীর দুই সাবেক প্রধান মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সুলতান মাহমুদ রায়ের সময় উপস্থিত ছিলেন আদালতে।

অপর আসামি ইউনাইটেড ট্রেডার্সের পরিচালক এ কে এম মুসা মামলার বিচার চলাকালে পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন। 

১৯৯২ সালে দায়ের করা এ মামলায় দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ৬৪ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকার ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছিল আসামিদের বিরুদ্ধে।

তাদের পক্ষে মামলা লড়া আইনজীবী শামসুদ্দিন বাবুল, শেখ সিরাজুল ইসলাম ও আলতাফ হোসেন রায়ের পর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে দুদকের কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে পর্যালোচনার পর তারা উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

যে কারণে খালাস

রায়ে বিচারক বলেছেন, কোন আসামি কীভাবে এই রাষ্ট্রীয় টাকা আত্মসাত করেছেন, সেটা প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের বক্তব্যে আসেনি। এ কারণে এই অভিযোগ ‘সন্দেহের উদ্রেক করে’।

“এই মামলার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব এম এ আনিসুজ্জামান, তৎকালীন মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী। তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। এ কারণে সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রমাণে ব্যার্থ হয়েছে।”

এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ইউনাইটেড ট্রেডার্সের পরিচালক শাহজাদ আলী অন্যদের দায়ী করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তাকে পরে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

যে হাকিম শাহজাদ আলীর জবানবন্দি নিয়েছিলেন, তাকে আসামিপক্ষ জেরা করার সুযোগ পায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।

এরশাদ নির্বিকার, বাবলু ‘খুশি’

সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ এদিন আদালতে এসেছিলেন কালো সাফারি পরে। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আদালতে প্রাঙ্গণে পৌঁছানোর পর পৌনে ৪টার দিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বিচার কক্ষে প্রবেশ করেন।

অবশ্য পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং কাজী ফিরোজ রশীদ তার আগেই সেখানে হাজির ছিলেন।

একদল নেতা-কর্মীকে এ সময় আদালত চত্বরে এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে স্লোগান দিতেও দেখা যায়।

আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর ৮৭ বছর বয়সী এরশাদকে বসতে দেওয়া হয় আসামির কাঠগড়ার কোনায় একটি চেয়ারে। রায় ঘোষণার শুরুতে তিনি দৃশ্যত নির্বিকার ছিলেন। রায়ের পরেও তিনি কোনো কথা বলেননি।

বিচারক আসামিদের খালাস দেওয়ার পর উপস্থিত জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ সম্বস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে ওঠেন।

জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি খুশি, খুব খুশি।”

মামলা পরিক্রমা

১৯৯২ সালের ৪ মে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করে।

ফ্রান্সের থমসন সিএসএফ কোম্পানির ‘অত্যাধুনিক’ রাডার না কিনে বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ওয়েস্টিন হাউজের রাডার কিনে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ আনা হয় মামলার এজাহারে।

তদন্ত শেষে ১৯৯৪ সালের ২৭ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ১৯৯৫ সালের ১২ অগাস্ট এরশাদসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হলেও ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্টের আদেশে স্থগিত থাকে।

আইনি বাধা কাটলে মামলা হওয়ার ১৮ বছর পর ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট শুরু হয় বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ। রাষ্ট্রপক্ষের ৩৮ সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৪ সালের ১৫ মে এরশাদ আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে লিখিত বক্তব্য দেন।

অন্য দুই আসামি বিমান বাহিনীর সাবেক দুই শীর্ষ কর্মকর্তা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সুলতান মাহমুদও সেদিন নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বক্তব্য দেন।

বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে ২০১৪ সালে ঢাকার তৎকালীন বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবদুর রশীদ যুক্তিতর্ক শুনানি নিতে বিব্রত বোধ করেন। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার জেলা জজ আদালতে বদলির কথা থাকলেও তা বদলি করা হয় মহানগর দায়রা জজ আদালতে।

দুদক সেখানে পুনরায় সাক্ষ্য নেওয়ার আবেদন করলে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কামরুল হোসেন মোল্লা গত ৮ নভেম্বর তা খারিজ করে দেন। এরপর দুদকের আবেদনে হাই কোর্ট ২৪ নভেম্বর এক আদেশে বলে, যে সাক্ষীদের বক্তব্য শোনা হয়নি, তা শেষে করে ৩১ মার্চের মধ্যে এ মামলার বিচার শেষ করতে হবে।

ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন এ মামলার আসামি সুলতান মাহমুদ। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দেয়।

দুদক ওই আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও তা ধোপে টেকেনি। ফলে গত ২৮ মার্চ বিচারিক আদালতে ফের এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়  এবং শুনানি শেষে গত ১৮ এপ্রিল বিচারক রায়ের দিন ঠিক করে দেন।

১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে ৪২টি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে তিনটি মামলায় তার সাজার আদেশ হয় এবং একটিতে তিনি সাজা খাটা শেষ করেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এরশাদ নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দেন, তাতে তখনও আটটি মামলা থাকার কথা বলা ছিল। বাকি মামলাগুলো থেকে তিনি খালাস বা অব্যাহতি পেয়েছেন, অথবা মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

বাকি আট মামলার মধ্যে চারটির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে।

জজ আদালতে শুনানির শেষ পর্যায়ে গিয়েও মঞ্জুর হত্যা মামলায় পুনঃতদন্তের আদেশ হয়েছে ২০১৪ সালে। উপহার দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে এরশাদের আপিলের রায় হবে ৯ মে। আর রাডার দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালতের রায় হওয়ায় তা হাই কোর্টে আপিলের পর্যায়ে গেল।