বাবার পর মেয়েরও হার সেই সাক্কুর কাছে

মেয়র পদে মনিরুল হক সাক্কুর উপরই ভরসা রাখলেন কুমিল্লাবাসী; ১১ হাজার ভোটে তিনি হারিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2017, 02:12 PM
Updated : 30 March 2017, 07:05 PM

২০১২ সালে সীমার বাবা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আফজল খানকে হারিয়ে কুমিল্লার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি নেতা সাক্কু।

নির্দলীয় সেই নির্বাচনে হাঁস প্রতীকের সাক্কুর সঙ্গে আনারস প্রতীকের আফজলের ভোটের ব্যবধান ছিল ২৯ হাজার।

এবার দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভর করে কুমিল্লায় নগর কর্তৃপক্ষে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন ৪৬ বছর বয়সী সীমা।

অন্যদিকে ৫৫ বছর বয়সী সাক্কু ভোট চেয়েছেন নগরে তার অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

রাতে ভোটের ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, মেয়র পদে সরকারবিরোধী দলের নেতা সাক্কুকেই রেখে দিয়েছেন কুমিল্লার ভোটাররা।

জঙ্গি অভিযানের আতঙ্ক ছাপিয়ে মানুষের ব্যাপক সাড়ার মধ্যে বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়।

বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল সমন্বয় করে কুমিল্লা টাউন হলে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ফল ঘোষণা শুরু হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে, যেখানে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দিন মণ্ডল ছিলেন। 

ফল ঘোষণা চলছে টাউন হলে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে

রাত ৯টার মধ্যে ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টির ফল ঘোষণা হয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে।

এতে ধানের শীষ প্রতীকে সাক্কু পেয়েছেন ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট; নৌকা প্রতীকে আঞ্জুম সুলতানা সীমার ভোট ৫৭ হাজার ৮৬৩।

অনিয়ম ও গোলযোগের কারণে দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়েছে। সে দুটি কেন্দ্রের মোট ভোট সংখ্যা (৫২৫৫) সাক্কু ও সীমার ব্যবধানের চেয়ে কম হওয়ায় তা মেয়র পদে ফলে কোনো প্রভাব রাখছে না।

ফল ঘোষণাস্থল টাউন হলে সাক্কু জয়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেছেন, ভোট পুরোপুরি সুষ্ঠু হলে তিনি আরও বড় ব্যবধানে জিততেন।

তিনি বলেন, “এবারের নির্বাচনে অনেক বেগ পেতে হয়েছে, অনেক হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়েছে আমাকে ও আমার কর্মী-সমর্থকদের।”

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতা বলেন, তারা ‘কাঙ্ক্ষিত সহায়তা’ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

তবে ভোটে বিজয়ী করার জন্য নগরবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে সাক্কু বলেন, “অতীতের মতো আমি নগরবাসীর পাশে থাকব।”

সকালে ভোটের শুরুতে দেখা গিয়েছিল আঞ্জুম সুলতানা সীমার এই হাসি, যা থাকেনি শেষে

ভোটের ফল যাই হোক, তা মেনে নেবেন বলে আগেই জানিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী সীমা। ফল ঘোষণার পর বিজয়ী প্রার্থী সাক্কুকে অভিনন্দন জানিয়ে দায়িত্ব পালনের তাকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন সাবেক কাউন্সিলর সীমা।

গত বারের নির্বাচনে মোট ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৩ জন ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার ৭২ জন ভোট দিয়েছিলেন। ভোটের হার ছিল ৭৫ দশমিক ০৬ শতাংশ।

এবার ভোটের হার তা ছাড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত সকালে নির্বাচন কর্মকর্তারা দিলেও গণনা শেষে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোটের হার ৬৫ শতাংশ ছাড়ায়নি।

এবার ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ জন। তার মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৯০ জন। ভোটের হার ৬৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।

নারী ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল না

নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটটির দিকে যে দৃষ্টি ছিল গোটা দেশবাসীর, তা সিইসি কে এম নূরুল হুদার উপলব্ধিতেও এসেছিল।

বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, এই ভোটের মধ্য দিয়ে শতভাগ জনআস্থা অর্জন করেছেন বলে তারা মনে করছেন।

মোটামুটি গোলযোগ ছাড়াই সকাল ৮টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে এই সিটি করপোরেশনে।

কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। হাতবোমা ফাটিয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে একটি কেন্দ্রের বাইরে। অনিয়ম ও গোলযোগের কারণ ভোট স্থগিত হয়েছে দুটি কেন্দ্রে।

সাক্কু তার এজেন্টদের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগ আনেন।

মনিরুল হক সাক্কুর দাবি, ভোট পুরোপুরি সুষ্ঠু হলে আরও বড় ব্যবধানে জিততেন তিনি

অন্যদিকে সরকারি দলের প্রার্থী সীমা ভোটচিত্রে নিজের সন্তুষ্টি জানিয়ে বলেন, ফল যাই হোক না কেন তিনি তা মেনে নেবেন।

ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে করে ভোটের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে হয়, তার প্রতিফলন ঘটেছে কুমিল্লায়।

অন্যদিকে বিএনপি বলছে, এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবির যৌক্তিকতা আবার তুলে ধরেছে।  

বিএনপি ভোট সুষ্ঠু হয়নি বলে দাবি করলেও এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল সন্তুষ্ট ছিলেন সার্বিক পরিস্থিতিতে।

ভোট শেষে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুটি কেন্দ্র গোলযোগের কারণে স্থগিত করা হয়েছে। আর সব জায়গায় শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে।”

সিটি কলেজ কেন্দ্রে ঘটে হাতবোমার বিস্ফোরণ

সাক্কু ও সীমা ছাড়াও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির শিরিন আক্তার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মামুনুর রশীদ মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শিরীন ২৬৩ এবং মামুন ৭৬৬ ভোট পেয়েছেন।

সিটি করপোরেশনের ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ১১৪ জন এবং নয়টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ৪০ জন প্রার্থী ছিলেন এবার।

দুটি পৌরসভা নিয়ে ২০১১ সালের জুলাই মাসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর এটা ছিল দ্বিতীয় নির্বাচন।

মডার্ন স্কুল কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের চিত্র

ভোটের আগের দিন শহরের কোটবাড়ী এলাকায় একটি ‘জঙ্গি আস্তানা’র সন্ধান মেলায় কিছুটা উত্তাপ ছড়ায় কুমিল্লাবাসীর মধ্যে।

বুধবার ভোটের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের এলাকার এক প্রান্তে ওই বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। এ ঘটনা জনমনে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হলেও ভোটারদের উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহ্বান জানান সিইসি নূরুল হুদা।

শেষ পর্যন্ত সেই আতঙ্ক ছাপিয়ে আনন্দ নিয়েই ভোট দেন ওই জঙ্গি আস্তানার আশপাশের তিনটি কেন্দ্রের ভোটাররা।