ভারতের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ চুক্তি নিরাপত্তা বাহিনী মানবে না: বিএনপি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফরে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিএনপি বলছে, ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কোনো চুক্তি হলে তা নিরাপত্তা বাহিনী মানবে না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2017, 01:56 PM
Updated : 7 March 2017, 02:25 PM

মঙ্গলবার এক আলোচনা সভায় দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ২৫ বছর গোলামি চুক্তি করেছিল ভারতের সাথে। উনার (প্রধানমন্ত্রী) এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে ভারতে যে সফর হবে, আমরা যেটা দেখতে পারছি, গুণগুণ করে মানুষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, সংবাদপত্রেও এসেছে-একটা সামরিক চুক্তি হতে যাচ্ছে।

“আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়, ভারতের কথা অনুযায়ী, ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা নীতি যদি গ্রহণ করতে হয়, তাহলে এদেশের স্বাধীনতা থাকবে না। এই ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে এদেশের জনগণ মানবে না, নিরাপত্তা বাহিনী মানবে না, কেউ মানবে না। তারা প্রতিরোধে এগিয়ে যাবে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সম্প্রসারিত প্রতিরক্ষা চুক্তি চাইছে; যাতে প্রশিক্ষণ, সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি এবং দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়গুলো থাকবে বলে হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ঢাকাকে সামরিক সহযোগিতার জন্য ভারত এলওসির আওতায় ৫০ কোটি ডলার দিতে চায় বলেও জানিয়েছে পত্রিকাটি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে রিজভী বলেন, সম্প্রতি চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনার জন্য বাংলাদেশের উপর ভারত ‘গোসা’ করেছে।

“তাই তাকে (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) অত্যন্ত আদর-আপ্যায়ন করতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডেকে নিয়ে গিয়ে ভারত সেখানে পবিত্র জল ছিটিয়ে চায়নার প্রভাবমুক্ত করতে চায়।”

প্রধানমন্ত্রীর এই সফর নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, “বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আমাদের চিরস্থায়ীভাবে যাতে গোলামে পরিণত না করতে পারে সেজন্য রুখে দাঁড়াতে হবে। একবার ২৫ বছর চুক্তির মাধ্যমে যেভাবে দাসখত লিখে দেয়া হয়েছিল, সেটার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।”

বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১১তম কারাবন্দি দিবস উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এই আলোচনা সভা হয়।

সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের এই দিনে তারেক রহমান গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে চিকিৎসার জন্য জামিনে মুক্তি নিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। এরপর আর ফেরা হয়নি খালেদা জিয়ার বড় ছেলের।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানও ভারত-বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তির বিরোধিতা করেন।

তিনি বলেন, “আমি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে পর্যালোচনা করব, যেটি সম্পূর্ণ নির্মোহ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা এমন একটি ভূ-অবস্থানে অধিষ্ঠিত, যার তিন দিকে রয়েছে  একটি অত্যন্ত পরম বন্ধু রাষ্ট্র। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে, যে দেশের তিন দিকে একটি পরম বন্ধু রাষ্ট্র আছে, তাহলে প্রতিরক্ষার প্রশ্নটি উঠবে কেন?”

চুক্তির বিরোধিতা করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, “৫০ কোটি ডলার খরচ করবে ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য। কেন? একটা স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ, আমাদের নিরাপত্তা কেন ভারতের উপর নির্ভরশীল হবে-এটা সবচাইতে বড় প্রশ্ন।

“বাংলাদেশের সরকার কি বুঝতে পারছেন না, এই ধরনের নানা প্রক্রিয়া ও তামাশার মধ্য দিয়ে আজকে সিকিম ভারতের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। আজকে ভুটান অঙ্গীভূত না হলেও ভারতের  করদ মিত্র রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ভারতের কারেন্সি সেখানে চলে, ভারতের সেনাবাহিনী সেখানে অবস্থান করে। ইন টার্মস অব পপুলেশন আমরা একটি বৃহৎ শক্তিশালী দেশ। আর এদেশে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী অনেক শক্তিশালী, আমাদের সেনাবাহিনী আছে, আমাদের বিমান বাহিনী আছে, আমাদের নৌ বাহিনী আছে। এখানে কিসের নির্ভরশীলতা, কার জন্য নির্ভরশীলতা, কিসের চুক্তি?”

এই চুক্তি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দয়া করে প্রধানমন্ত্রী আপনি লেন্দুপ দর্জি হতে যেয়েন না। লেন্দুপ দর্জির পরিণতি কিন্তু খুব খারাপ হয়েছে। পরে শিলিগুঁড়ির একটি অখ্যাত বস্তিতে তাকে অবস্থান করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, আপনার দেশের এতো জনসংখ্যা, সেখানে আপনি বাংলাদেশের নিরাপত্তা অন্যের হাতে তুলে দেবেন- এটা হতে পারে না।”

তিনি বলেন, “এই সমস্ত চুক্তি বা স্মারক সইয়ের মধ্য দিয়ে ভেতরের যে বিষয়টি থাকবে, তা জনগণ জানতে পারবে না। এখন বাংলাদেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে এটাকে নাশকতা বলে চালিয়ে যদি এমন হয় যে, এখানে নাশকতার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে ‘আমরা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে এসে অ্যাটাক করছি’। তাহলে স্বাধীনতা কোথায় থাকল, সার্বভৌমত্ব কোথায় থাকল?”

আশঙ্কা প্রকাশ করে রিজভী বলেন, “এখন যদি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা স্বার্থকে আমরা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারাব। এর পরিণতি কী ভয়ঙ্কর দিকে যাবে, সেটা এখন অনেক মানুষ বুঝতে পারছেন, এদেশের জনগণ উপলব্ধি করছেন।”

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারে অর্ধশত চুক্তি হয়েছে দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “সেগুলোর অনেক চুক্তি প্রকাশ করা হয়নি। এটা অত্যন্ত একটি বিপজ্জনক বিষয়। তারপরে এখন যেটা আশঙ্কা প্রকাশ করছিলাম, সেই প্রতিরক্ষা চুক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

“এই কাজগুলো করবেন বলেই জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারাবাহিক নেতৃত্বকে বিপর্যস্ত করার জন্য এক এগারো সৃষ্টি হয়েছিল, তাদের (আওয়ামী লীগ) আন্দোলনের ফসল হিসেবে তারেক রহমানকে নির্যাতন করা হয়েছে।”

বক্তব্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল দেখানোর পিছনে সংস্কৃতি ‘ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তোলেন রিজভী।

তার নানা বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জানিয়ে রুহুল কবির রিজভী বলেন, “কয়েকবার সেখানে গেছি, ওখানে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে পায় বলে আমি শুনিনি। আর আমাদের দেশে ভারতের চ্যানেলে সয়লাব। বাংলাদেশের একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র আবহমানকালের সাংস্কৃতিক স্রোতধারাকে ধবংস করে দেওয়ার জন্য উত্তরভারতীয় সংস্কৃতি দিয়ে সয়লাব করে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা চলছে।”

সংগঠনের সভানেত্রী শামা ওবায়েদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুন রায় চৌধুরী, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।

‘বিএনপি ছাড়া আর কোনো ভোট হবে না’

বিএনপিকে ছাড়া দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না মন্তব্য করে দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অগ্রীম কথা বলে তাদের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র করছেন।

সকালে এক মানববন্ধনে তিনি বলেন, “নিবন্ধন বাতিলের ভয় দেখিয়ে আপনারা বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছেন, আল্লাহর অসীম রহমত ও জনগণ ছাড়া বিএনপির নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা আওয়ামী লীগের নাই।”

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও আন্দোলনের উদ্যোগে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে এক মানবন্ধন হয়।

কেএম রফিকুল ইসলাম রিপনের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বিএনপির উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম আজাদ, কাদের গনি চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম বাবুল, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ডেমোক্রেটিক লীগের সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি বক্তব্য রাখেন।