ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, নারী ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়তা এবং প্রতিপক্ষ শিবিরে সমন্বয়হীনতার বিপরীতে দলের নির্দ্বন্দ্ব সমর্থন- এই তিন নিয়ামকে ভর করে আইভী আবারও পাঁচ বছরের জন্য নারায়ণগঞ্জ নগর সেবার দায়িত্ব পেয়েছেন বলে মনে করছেন মিজানুর রহমান শেলী ও আব্দুল আলীম।
কয়েকটি মহিলা ভোটকেন্দ্রের ফল বিশ্লেষণে বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের চেয়ে আইভীর পাল্লা ভারী হওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে। বিএনপির স্থানীয় নেতাদের নিজেদের কেন্দ্রগুলোতে ভোটের হার বিশ্লেষণেও তাদের প্রার্থীর পিছিয়ে পড়ার চিত্র এসেছে।
২০১১ সালে নির্দলীয় ভোটে দলীয় নেতাদের সমর্থনপুষ্ট এ কে এম শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে হারিয়ে দেশের প্রথম নারী মেয়র হয়েছিলেন আইভী। এবার নৌকার প্রতীকে ভোট করায় দলের মধ্যে উল্টো হাওয়া মোকাবেলা করতে হয়নি তাকে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ৮০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। গতবারের চেয়ে কম ভোট পড়া এই নির্বাচনে মোট ভোটের হিসাবে পাঁচ হাজার কমেছে তার।
তার মতে, তৃণমূলে সাধারণের সঙ্গে মিলেমিশে থাকায় নারায়ণগঞ্জে আইভীর যে ভাবমূর্তি তা সেখানকার অন্য রাজনীতিবিদদের থেকে তার ভালো অবস্থান তৈরি করেছে। এছাড়া বাবার ইতিহাস, আইভীর সততা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার কারণে একটা ‘ভোট ব্যাংক’ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে নৌকা প্রতীক।
আইভীর জয়ের পিছনে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতি জনআস্থার প্রমাণ মিলেছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করলেও তা মানতে নারাজ এরশাদ সরকারের এই মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “শুধু উন্নয়ন করলে তা বিশেষ গুরুত্ব পায় না, যদি না অংশগ্রহণমূলক হয়। পাকিস্তান ও এরশাদ সরকারের আমলে উন্নয়ন ছিল, তখন তা অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় টেকেনি। নারায়ণগঞ্জেও তা বড় বিবেচনায় এসেছে বলে মনে করি না।
“মূল ব্যবধানটা তৈরি হয় প্রার্থীর ইমেজের ওপর। দলের ভোট ব্যাংক বরাবরই একটা জায়গায় থাকে।”
এছাড়া আইভীর মনোনয়ন দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর উদ্যোগে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে প্রার্থী হিসেবে মাঠের রাজনীতিতে নতুন সাখাওয়াতের পক্ষে ‘স্থানীয় বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারাকে’ ভোটের ব্যবধান বাড়ার কারণ বলছেন তিনি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীমের মতে, বাবার পর ১৩ বছর জনপ্রতিনিধি হিসেবে আইভীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি ধরে রাখা এবং নারী প্রার্থী হিসেবে নারী ভোটারদের বিশেষ সহমর্মিতা তার দ্বিতীয় দফা জয়ের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে দলীয় প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের‘ভোট ব্যাংকের’ একটি অংশ তার পক্ষেও গেছে।
“দলীয় প্রার্থী হলেও ব্যক্তি ভোট ফ্যাক্টর আইভীর জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।”
এ কারণে নারায়ণগঞ্জের ভোটের চিত্র দিয়ে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রিয়তা ও অন্যান্য মানদণ্ড ধরা ঠিক হবে না বলে মনে করেন তিনি।
তবে ভোটের পরিবেশ ধরে রাখতে নারায়ণগঞ্জ অনুসরণীয় হতে পারে বলে মন্তব্য করেন এই নির্বাচন পর্যবেক্ষক।
নারী ভোটে ‘আইভী জোয়ার’
নারায়ণগঞ্জে এবারও নারী ভোটারদের বেশি উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। কয়েকটি নারী ভোটকেন্দ্রের ফল পর্যালোচনায় আইভীর পক্ষে বেশি সমর্থন দেখা গেছে।
নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডে সফুরা খাতুন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মহিলা ভোটকেন্দ্রে ২ হাজার ৫৫৯ জন ভোটারের মধ্যে মেয়র পদে ভোট দিয়েছেন ১ হাজার ৭৯৮ জন নারী। এর মধ্যে আইভি পেয়েছেন ১ হাজার ২০০ ভোট, আর সাখাওয়াতের পক্ষে গেছে ৪৬৯ ভোট।
১৩ নম্বর ওয়ার্ডে নারায়ণগঞ্জ আইডিয়াল স্কুলের মহিলা ভোটকেন্দ্রে মেয়রপদে ১ হাজার ১২৮ ভোট পড়ে, যেখানে আইভি ৯০৬ ভোট এবং সাখাওয়াত পেয়েছেন ২১০ ভোট।
১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৯৩ নম্বর বিদ্যা নিকেতন মহিলা ভোটকেন্দ্রে ২ হাজার ৯০৪ জন ভোটারের মধ্যে মেয়র পদে ভোট দেন ১ হাজার ৫৯৫ জন। এর মধ্যে আইভি পেয়েছেন ১০৩০ ভোট, সাখাওয়াত পেয়েছেন ৪৯৬ ভোট।
২৭ নম্বর ওয়ার্ডে কুড়িপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের মহিলা ভোটকেন্দ্রে আইভী পেয়েছেন ৯৪২ ভোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাখাওয়াত পেয়েছেন ২৬৯ ভোট।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে পৌনে পাঁচ লাখ ভোটারের মধ্যে নারী ভোটার দুই লাখ ৩৫ হাজারের বেশি।
বিএনপি নেতাদের কেন্দ্রেও সাখাওয়াতের হার
বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান নিজের কেন্দ্রেই হেরেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী আ্ইভীর কাছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালী বিএনপি নেতাদের কেন্দ্রেও ভালো করতে পারেননি তিনি।
গত নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে মেয়র পদে লড়াই করা জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারের বাড়ির কাছে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নারায়ণগঞ্জ ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা কেন্দ্র। সেখানে সাখাওয়াতের ধানের শীষে পড়েছে ৬৭০ ভোট, আর নৌকায় সিল পড়েছে ৮৩৭টি ব্যালটে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী এই কেন্দ্রে সাখাওয়াতের চেয়ে ১৬৭ ভোট বেশি পেলেও তৈমুরের ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ কাউন্সিলর পদে পেয়েছেন এক হাজার ২৩১ ভোট।
অর্থাৎ, বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীকে যারা ভোট দিয়েছেন, তারা সবাই বিএনপির মেয়র প্রার্থীর ওপর আস্থা রাখতে পারেননি।
বিএনপির নগর সম্পাদক এটিএম কামাল ভোট দিয়েছেন ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি কেন্দ্রে। এ কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৭৬৩ ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছেন। বিএনপির প্রার্থী পেয়েছেন ৬৫৯ ভোট।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক আবুল কালাম ভোট দেন ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল কেন্দ্রে। সেখানে ধানের শীষে ২৯৮ ভোটের বিপরীতে নৌকায় পড়েছে ৯৫৯ ভোট।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের বিএনপিরআরেক সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের রেবতী মহন পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন। এ স্কুল ভবনের দুটি কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থী যথাক্রমে ৬৪৯ এবং ১ হাজার ৩৩টি ভোট পেয়েছেন। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী আইভী পেয়েছেন ১ হাজার ১১৮ এবং ১ হাজার ২৪৬ ভোট।
ভোট কমেছে ‘ছুটিতে’
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জে ভোট পড়েছে ৬৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এবার পড়েছে ৬২ দশমিক ২২ শতাংশ।
এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটের দিন ও পরের দুদিন শুক্র-শনিবার মিলিয়ে তিনদিনের ছুটি পাওয়ায় হয়ত অনেক শ্রমিক এলাকায় ছিলেন না এবং অনেকে অন্যত্র চলে গেছেন।
“এটা একটা কারণ হতে পারে বলে মনে করছি।”
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন ফয়সাল আতিক।