সেই চুনকার মেয়েতেই আস্থা নারায়ণগঞ্জবাসীর

সারাদেশের মানুষ সেলিনা হায়াৎ আইভীকে চেয়ারম‌্যান এবং এখন মেয়র হিসেবে জানলেও নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে তার প্রথম পরিচয় আলী আহমেদ চুনকার মেয়ে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Dec 2016, 07:48 PM
Updated : 23 Dec 2016, 09:39 AM

নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম‌্যান চুনকা আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে ছিলেন ব‌্যাপক জনপ্রিয়। বাণিজ‌্য শহর নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক নেতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা সাংবাদিক আফসার বিপুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অত‌্যন্ত সাদাসিধে জীবনে অভ‌্যস্ত চুনকাকে অনেকে পীরের মতো জানতেন। তার মৃত‌্যুবার্ষিকীতে অনেক ভক্তকে ওরস করতেও দেখেছি।”

চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি নিয়ে প্রবাস থেকে ফেরার পর ২০০৩ সালে আইভী যখন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় ভোটে দাঁড়ান, তখন চুনকার মেয়ে হিসেবেই তাকে বিজয়ী করেছিলেন ভোটাররা।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে যখন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুর্দিন চলছিল, তখন দলের হাল ধরেছিলেন আইভী।

১৯৬৬ সালের ৫ জুন জন্ম নেওয়া আইভী তার আগে রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিলেন না।

১৯৯২ সালে রাশিয়ার ওডেসা পিগারভ মেডিকেল ইনস্টিটিউট থেকে ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ডিগ্রি নেওয়ার পর মিডফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করার সময় ছাত্রলীগে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এরপর ১৯৯৪ সাল থেকে এক বছর নারায়ণগঞ্জের ২০০ শয্যা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর উচ্চতর পড়াশোনা করতে তিনি চলে যান নিউজিল্যান্ডে।

সেখান থেকে ২০০২ সালে ফিরে আসার পরই নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচনের মধ‌্য দিয়ে সক্রিয় হন রাজনীতিতে। শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক হন।

পেশাগত অবস্থানের বলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ নারায়ণগঞ্জ শাখার আহ্বায়কও হন দুই ছেলের জননী আইভী। আইভী দেশে ফিরলেও তার স্বামী কাজী আহসান হায়াত থেকে যান নিউ জিল‌্যান্ডে।

সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন অবসানের পর নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের সদস‌্যরা সক্রিয় হয়ে উঠলে তাদের জন‌্য চ‌্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ান আইভী। আওয়ামী লীগের বাইরে বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এসময় পাশে পান তিনি।

পৌরসভা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন হওয়ার পর ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে ফের প্রার্থী হন আইভী।

নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে কেন্দ্রীয় অনেক নেতার আশীর্বাদপুষ্ট এ কে এম শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে হারিয়ে বাংলাদেশের কোনো সিটি করপোরেশনের প্রথম নারী মেয়র হন আইভী।

তারপর থেকে ওসমান পরিবারের সঙ্গে তার বিরোধ চরমে ওঠে; তবে এই দ্বন্দ্ব পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছেন তারা।

আলী আহমেদ চুনকা

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ওসমানদের বিরোধী শিবির থেকেই স্বাধীনতার পর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম‌্যান হয়েছিলেন আইভীর বাবা চুনকা।

ভোটের পর ত্বকী হত‌্যাকাণ্ড এবং সাত খুন নিয়ে আইভী ও শামীম ওসমানকে প্রকাশ‌্যে সভায় একে অন‌্যের বিষোদগারের পাশাপাশি টেলিভিশন বিতর্কে মারমুখী হয়ে উঠতেও দেখা যায়।

এবার ভোটের আগে আইভী আবার প্রার্থী হতে চাইলে সংসদ সদস‌্য শামীম ওসমানের সমর্থকরা তা আটকাতে চেয়েছিল। নগর আওয়ামী লীগ থেকে আনোয়ার হোসেনসহ তিনজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করে পাঠানো হয়েছিল কেন্দ্রে।

এই আনোয়ার হোসেন গতবার আইভীর নির্বাচনের প্রথম সমন্বয়ক ছিলেন, তবে এবার তিনি শামীম শিবিরে নাম লেখান।

নিজের জেলায় দলের মধ‌্যে বিরোধিতায়ও হাল ছাড়েননি আইভী; আইন সংশোধনের পর দলীয় প্রতীকের এই নির্বাচনের জন‌্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে আইভীকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়।

সেইসঙ্গে শামীম ওসমানকেও কঠোরভাবে সতর্ক করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে শামীম সংবাদ সম্মেলন করে আইভএক ছোট বোন আখ‌্যায়িত করে তার প্রতি সমর্থন জানান; তবে নির্বাচনী বিধির কারণে প্রচারে নামার সুযোগ ছিল না এই সংসদ সদস‌্যের।

আইভীও শামীম সমর্থকদের সরিয়ে রেখে তার আগের সঙ্গীদের নিয়েই প্রচার চালান।

গতবার বিএনপির বর্জনের মধ্যে শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে হারানো আইভী বৃহস্পতিবারের ভোটে ধানের শীষের প্রার্থীকেও পৌনে এক লাখ ভোটে হারিয়ে মেয়র পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।

আট বছর পৌরসভার চেয়ারম‌্যান থাকার পর পাঁচ বছর মেয়র, নারায়ণগঞ্জে নাগরিক সেবার দায়িত্বভার ১৩ বছর আইভীর হাতে ছিল; এখন আরও পাঁচ বছর তাকে সেই দায়িত্ব দিলেন এই নগরীর ভোটাররা।    

সাংবাদিক আফসার বিপুল বলেন, “চুনকার মেয়ে হিসেবে ১৩ বছর আগে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন আইভী, এখন ক্রমে বাবাকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন তিনি।”