‘পদ ছেড়ে আইভীর পক্ষে প্রচারে নামতেও’ রাজি শামীম

নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে কোনো বিভেদ নেই দাবি করে সংসদ সদস‌্য এ কে এম শামীম ওসমান বলেছেন, ‘নেত্রী’ নির্দেশ দিলে সাংসদ পদ ছেড়েও দলের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে মাঠে নামতে প্রস্তুত আছেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2016, 12:48 PM
Updated : 9 Dec 2016, 12:48 PM

ক্ষমতাসীন দলের এ দুই নেতার মধ‌্যে পুরনো দ্বন্দ্ব নিয়ে সংবাদমাধ‌্যমে নানা খবরের মধ‌্যেই শুক্রবার শহরের নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের ছেলে শামীম।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়াণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইভীর হাতে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন। আইভীকে বার বার ‘ছোট বোন’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “আইভীই আওয়ামী লীগের যোগ্য প্রার্থী।”

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি পদে থাকায় নির্বাচনের আচরণ বিধি অনুযায়ী আইভীর পক্ষে ভোটের প্রচারে নামার যে সুযোগ নেই সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আমি শামীম ওসমান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছি না। তবে আমি তাও বলতে চাই- আমার বোন, আমার ছোট বোন আইভী যদি মনে করে যে ভাইয়া আপনাকে আমার পাশে দরকার আছে, এবং আমার নেত্রী যদি নির্দেশ দেয়, আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আগামীকাল সকালে আমি পার্লামেন্ট থেকে পদত‌্যাগ করে আমার ছোটবোনের সাথে প্রতিটা ঘরে ঘরে যাব।

“আর যদি এই সুযোগ না থাকে, যদি এই সুযোগ আমার নেত্রী আমাকে না দেন, আমি পৌরসভার বাইরে বসে আমার নির্বাচনী কাজ করার অধিকার আছে। নির্বাচন বিধিতে কোথাও এটা বিধান নাই যে আমি বাইরে বসে কথা বলতে পারব না। যদি এই বিধানই থাকে তাহলে টক শোতে বসে যারা বিভিন্নভাবে কথা বলছেন, সেটাও কিন্তু বিধান থাকতে পারে না।”

এ প্রসঙ্গে বিগত নির্বাচনে প্রার্থীদের নিয়ে টেলিভিশন টকশোতে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শামীম বলেন, “গতবার নির্বাচনে আমি টক শোতে দেখেছি কীভাবে বিভিন্ন টকশোতে বাংলাদেশের সো কলড সুশীল, কিংবা আঁতেল মানুষ যারা আছেন, আমাদের ‘জবাই’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমরা কিন্তু প্রতিবাদ করি নাই।”

পাঁচ বছর আগে এই শামীম ওসমানকে হারিয়েই নারায়ণগঞ্জের প্রথম মেয়র হয়েছিলেন আইভী। তাদের দুজনের এই দ্বন্দ্ব পারিবারিক উত্তরাধিকার। ওসমানদের বিরোধী শিবির থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম‌্যান হয়েছিলেন আইভীর বাবা আলী আহমেদ চুনকা।

ভোটের পর ত্বকী হত‌্যাকাণ্ড এবং সাত খুন নিয়ে আইভী ও শামীমের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। প্রকাশ‌্য সভায় একে অন‌্যের বিষোদগারের পাশাপাশি টেলিভিশন বিতর্কে তাদের মারমুখী ভূমিকায়ও দেখা যায়।

এবারের নির্বাচন সামনে রেখে শামীম প্রভাবিত নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগ মেয়র পদে মনোনয়নের জন‌্য যে তিন নেতার নাম দিয়েছিল তার মধ‌্যে ছিলেন না আইভী।

তবে গত এক যুগের বেশি নারায়ণগঞ্জবাসীর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করা জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি আইভীর উপরেই আস্থা রাখে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

তার মনোনয়নে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগ নারায়ণগঞ্জে নৌকার জয় আনতে পারবে কি না সে শঙ্কার মধ‌্যে শামীম ও আইভীকে নিয়ে গণভবনে বসেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

তখন দুজন সংবাদমাধ‌্যমে কোনো কথা না বললেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইভীর জন‌্য কাজ করবেন দলের নেতাকর্মীরা।

সে সময় চুপ থাকলেও সোমবার প্রতীক বরাদ্দের মধ‌্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পঞ্চম দিনে সংবাদ সম্মেলনে এলেন শামীম ওসমান।

আইভীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব এখন অতীত মন্তব‌্য করে তিনি বলেন, “আমরা ভাই-বোন ছিলাম। ভাই-বোন আছি। আমরা আওয়ামী লীগের পরিবার। আমরা সবাই একে অপরের ভাই। আর আমাদের মা হচ্ছে, আদর্শের মা শেখ হাসিনা। সেখানে বিভেদ নাই।

“এক পরিবারে তিনটা ভাই থাকলে দ্বন্দ্ব-বিভেদ হয়। আর শেখ হাসিনার পরিবার তো ছোট্ট পরিবার না। দুই কোটি কর্মীর পরিবার হচ্ছে শেখ হাসিনার পরিবার। এখানে তো ঝগড়া-ঝাঁটি, খারাপ কথা বলা, রাগ করা, অভিমান করা হতেই পারে। তবে সেটা ওই ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য আমরা বৃহত্তর স্বার্থ ত্যাগ করব না।”

দলীয় প্রার্থী আইভীকে বিজয়ী করে আনার আশা প্রকাশ করে শামীম বলেন, আইভী তার ‘ইয়ঙ্গার সিস্টার’।

তার জন‌্য ভোট চাইতে মানুষের কাছে যেতে ‘মন চায়’ বলে মন্তব‌্য করেন তিনি।

নিজে মাঠে যেতে না পারলেও শনিবার থেকে নিজের নেতাকর্মীদের নৌকার পক্ষে ভোটের প্রচারে পাঠাবেন জানিয়ে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘কাল থেকে দেখবেন’।

“আনোয়ার ভাই যাচ্ছেন, খোকন শাহ যাচ্ছে, বাদল যাচ্ছে, সব নেতোরা যাচ্ছে আমার ছোট বোন আইভীর সাথে কাজ করতে। আগামীকাল থেকে আরও ব‌্যাপকভাবে যাবে। আইভী কী কাজ করবে আমার দেখার দরকার নাই। নারায়ণগঞ্জের প্রতিটা অলিতে গলিতে আগামী কাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানুষের পায়ে হাত দিয়ে তাদের কাছে জননেত্রী শেখ হাসিনার নৌকার জন‌্য ভোট চাবে।”

‘চাপ থেকে নয়’ দলীয় সভানেত্রীর প্রতি আনুগত‌্য থেকে আইভীর পক্ষে তার এই অবস্থান জানিয়ে শামীম ওসমান বলেন, “আমি আওয়ামী লীগ করি, আওয়ামী লীগ করব এবং আওয়ামী লীগ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করব। আমি আরেকটা কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই- আমরা যারা পঁচাত্তরের পর জন্ম নিয়েছি আমরা কিন্তু ওয়ান মাস্টার ডগ। ওয়ান মাস্টার ডগ, আমাদের নেত্রী একটাই, শেখ হাসিনা।

“উনার ইচ্ছা, উনার কাছে যে ভালোবাসা আমরা পেয়েঠি, স্নেহ পেয়েছি, উনার জন্য যে কোনো ত্যাগ, যে কোনো তিতীক্ষা, যে কোনো সিদ্ধান্ত লিডার দেবে, সেইটা আমাদের শিরোধার্য।”

আইভীর জন্য নৌকা খচিত শাড়ি

আইভীকে উপহার দেওয়ার জন‌্য নৌকা প্রতীক খচিত শাড়ি তৈরি করিয়েছেন শামীম ওসমান। সেই শাড়ি সংবাদ সম্মেলনে দেখানোও হয়।

শামীম বলেন, “যেহেতু আমি আমার ছোট বোন আইভীর সাথে উপস্থিত থাকতে পারছি না, সেই কারণে আমি চিন্তা করলাম, নারায়ণগঞ্জে একটি প্রসিদ্ধ দোকান আছে, এটার নাম হচ্ছে বিশ্ব রঙ। এই রঙের যারা আছে, তাদের আমি অনুরোধ করেছি, যে আমাকে দুইটা শাড়ি এমনভাবে বানিয়ে দাও যাতে শাড়ি দুইটার মধ‌্যে নৌকা থাকে।

“এই নৌকা মার্কা শাড়ি দুটো পরে আমার আইভী যখন বিভিন্ন এলাকায় যাবে, তখন সে বুঝবে যে আমার ভাই আমার সাথে না থাকলেও আমার ভাইয়ের দোয়া আমার সাথে আছে।”

আইভীর প্রতি এখন আর ‘কোনো ক্ষোভ নেই’ জানিয়ে শামীম বলেন, “ওর প্রতি আমার কোনো রাগ, কষ্ট, দুঃখ, যা ছিল, আমি হযরত শাহজালালের মাজারে... আমার কষ্ট যখন লেগেছিল, আমি আমার অলির দরবারে গেছি, নামাজ পড়েছি, এবাদত করেছি, কোরআন পড়েছি, যা কষ্ট ছিল, সব ধুয়ে মুছে গেছে।”

তবে শাস্তি তাকে দেবেন দলের ‘বড় ভাই’ শামীম ওসমান।

“শাস্তি আমি আইভীকে একটা দেব। তবে শাস্তিটা হবে ২২ তারিখের পরে। জয়লাভ করার পর নেত্রীর কাছে যাব, আপনাদেরও বাইরে রাখব। চিন্তা কইরেন না। আমি আইসক্রিম খেতে খুব পছন্দ করি। ওকে ফাইন করব। এবং বলব আমাকে প্রচুর পরিমাণ আইসক্রিম খাওয়াও। বিকজ আই লাভ আইসক্রিম। আমাকে ওকে আইসক্রিম খাওয়াতে হবে।”

‘ঐক্য দৃঢ় নৌকার প্রতি চ্যালেঞ্জে’

দলের বিরোধ নিরসনে ‘নৌকার প্রতি চ‌্যালেঞ্জও’ ভূমিকা রেখেছে বলে মন্তব‌্য করেন শামীম।

তিনি বলেন, “আওয়ামী পরিবারে যা বিভেদ ছিল, যা দ্বন্দ্ব ছিল আজকে যারা আমাদের চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তাদের চ্যালেঞ্জের কারণে, আমরা বলতে চাই, তাদের চ‌্যালেঞ্জের কারণে আমাদের জন‌্য‌্য সুবিধা হয়েছে। কারণ তারা যখন নৌকাকে আঘাত করে কথা বলেছে, নৌকা ডুবিয়ে দেবে। নৌকা যখন ডোবানোর কথা বলে, আওয়ামী লীগের কর্মীর পায়ের রক্ত তখন মাথায় ওঠে।”

নৌকা নয়, ভোটে ধানের শীষের ভরাডুবি হবে মন্তব‌্য করে শামীম ওসমান বলেন, “আমরা জানি, শীতলক্ষ‌্যা নদীতে আপনারা আমাদের ডোবাতে পারবেন না। আর ধান এখন খড়কুটো হয়ে গেছে। সেই খড়কুটো ধরে ভাসাও এখন আপনাদের জন‌্য খুব কষ্টকর হবে।

“তবে চিন্তা কইরেন না। আপনারা যখন শীতলক্ষ‌্যা নদীতে খড়কুটো ধরে ভাসার চেষ্টা করবেন, আমরা জনগণের জন‌্য রাজনীতি করি, আমরা অবশ‌্যই নদী থেকে যাতে ডুবে না যান, উঠিয়ে আমাদের নৌকা দিয়েই আপনাদের পার করে দেব, যাতে আপনারা সুস্থভাবে ঢাকায় গিয়ে বসবাস করতে পারেন।”

বিএনপি প্রার্থী যতই হেঁটে হেঁটে ভোট চান না কেন, মানুষ তাদের ‘ভোট দেবে না’ বলে শামীমের বিশ্বাস।

বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানকে তিনি সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে বিতর্কে বসার আহ্বান জানান।

“আমি সাখাওয়াত সাহেবকে অনুরোধ করব, যে আপনি কেন ভোট চাবেন? কেন জনগণ আপনাকে ভোট দেবে? ‍যদি সৎ সাহস থাকে, আসেন, আমাদের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সাথে ঠিক এইভাবে দাঁড়িয়ে টেলিভিশনের সামনে ওপেন ডিবেটে আসেন।

“ওপেন ডিবেটে আসেন, কেন মানুষ নৌকায় ভোট দেবে, আর কেন মানুষ ধানের শীষে ভোট দেবে। কেন দিবে না, আমরা প্রমাণ করব। আর আপনি প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে কেন মানুষ নৌকায় ভোট দেবে না। আশা করি সেই দিন জনগণ বুঝতে পারবে যে কেন নৌকায় দেবে, আর কেন দেবে না।”

সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শামীম ওসমান বলেন, “আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলতে চাই, যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন বিএনপিসহ অন‌্যান‌্য রাজনৈতিক সংগঠন, আমরা আপনাদের পরিষ্কার ভাষায় আশ্বস্ত করতে চাই- নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন অতীতের যে কোনো সময়ের থেকে সুষ্ঠু, সুন্দর এবং আনন্দময় নির্বাচন হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহাসহ অন‌্যরা উপস্থিত ছিলেন।